প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ১৯৭ দেশ তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করলেও সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি ঠেকানো যাবে না। ফলে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতেই থাকবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল।
মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও জার্মানির পটসডাম ইনস্টিটিউট অব ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের এক গবেষণার বরাতে এ খবর জানিয়েছে ডয়েচে ভেলে।
বুধবার প্রকাশিত সেই গবেষণার ফলে বলা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২৩০০ সালের মধ্যে শূন্য দশমিক ৭ থেকে ১ দশমিক ২ মিটার বেড়ে যাবে৷
পরিবেশবিষয়ক বিখ্যাত জার্নাল নেচার কমিউনিকেশন্সে প্রকাশিত এই গবেষণায় আরো বলা হচ্ছে, এমনকি যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঠেকিয়েও রাখা যায়, সিস্টেমের জড়তার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি আটকে রাখা যাবে না৷’
শুধু তাই নয়, কার্বন ডাইঅক্সাইডের উদগীরণের মাত্রা শূন্যে নামিয়ে আনতে যদি দেরি হয়, তা হলে ২০২০ সালের পর থেকে প্রতি পাঁচ বছরের জন্য ২০ সেন্টিমিটার করে পানির উচ্চতা বাড়বে৷
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বরফ ও হিমবাহ গলে যাওয়ার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে৷ ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার কথা বলা হয়েছে৷
এ ছাড়া জলবায়ুসংক্রান্ত ঝুঁকি কমিয়ে আনতে এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ কার্বন ডাইঅক্সাইড নিরসনও সার্বিকভাবে শূন্যে নামিয়ে আনার শর্ত রাখা হয়েছে৷
কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন৷ কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের হার তো কমছেই না, বরং বাড়ছে। এবং তা আরও অন্তত এক দশক এই হার অব্যাহত থাকবে৷
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ যদি এখনই বন্ধ করে দেয়া হয়, তার পরও এরই মধ্যে আমরা পরিবেশের এতটাই ক্ষতি করে ফেলেছি যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আগামী কয়েক শতকে বেড়েই যাবে৷
তবে গবেষকরা বলছেন, যেসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে, তা নিলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ওপর তা কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিরূপণ করা হয়নি এখনো৷
গবেষণায় বলা হচ্ছে, ১ দশমিক ২ মিটার পানির উচ্চতা বৃদ্ধি মানে হল, বাংলাদেশসহ ভিয়েতনাম ও ভারতের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে ভয়াবহ বিপদ নেমে আসা৷ নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন চার্চের মতে, এ এলাকাগুলোতে এক মিটার উচ্চতার ঝুঁকিতে প্রায় ১০ কোটি মানুষ বাস করেন৷ তাদের বিপদ সবচেয়ে বেশি৷
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের সামনে এখন বিরাট চ্যালেঞ্জ৷ আগের অনেক গবেষণায় দেখানো হয়েছিল যে, ২০২০ সাল নাগাদ সমুদ্রে পানির উচ্চতা এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে, যার ফলে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ এলাকা অধিক হারে বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে৷
বাংলাদেশের ওপর সম্পাদিত গবেষণা থেকে জানা গেছে, ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ বর্তমানের তুলনায় বার্ষিক গড় তাপমাত্রা যথাক্রমে ১ ও ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২১০০ সাল নাগাদ ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে৷
একই সঙ্গে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের তুলনায় যথাক্রমে ১৪ ও ৩২ সেন্টিমিটার এবং ২১০০ সাল নাগাদ ৮৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে৷ ফলে বাংলাদেশের কমপক্ষে ১০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷
ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হবেন বলে অনুমান করা হচ্ছে৷ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬৭ সেন্টিমিটার বাড়লে গোটা সুন্দরবনই পানিতে তলিয়ে যাবে৷ ইতিমধ্যে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে অবস্থিত ‘লোহাচরা’ও ‘সুপারিভাঙ্গা’ নামের দুটি দ্বীপ হারিয়ে গেছে৷ লোহাচরা দ্বীপের মাত্র এক মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত প্রায় দেড় লাখ জনসংখ্যার ‘সাগরদ্বীপের ৩৩ দশমিক ৬২ বর্গকিলোমিটার এলাকা গত ৩০ বছরে সমুদ্রে তলিয়ে গেছে৷
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ভোলা দ্বীপও গত চার দশকে প্রায় ৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা হারিয়ে বর্তমানে ১৯৬৫ সালের তুলনায় অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে৷
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে এখনই উদ্যোগ যা নেয়া হচ্ছে, তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন জন চার্চ৷ তিনি বলেন, ২৩০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি রোধ করতে হলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আরও অনেক বাড়াতে হবে এবং তা এখনই৷
গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরেটাস ইয়ান লোয়ি বলেন, এই গবেষণাটি আরেকবার আমাদের মনে করিয়ে দিলো যে, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের উপকূলে কতটা ঝুঁকি তৈরি করে ফেলেছে৷
প্রাকৃতিক কারণে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষদের উচ্ছেদ ও জলবায়ু শরণার্থী হয়ে যাওয়া অস্ট্রেলিয়াসহ এসব দেশের জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি করবে বলে মনে করেন তিনি।