টেস্ট পরীক্ষা চলছে। তৃতীয় পরীক্ষার দিন বাসা থেকে বেরিয়েও হলে যায়নি ছেলেটি; দিন শেষে বাসায় ফেরেনি। ২০১৬ সালের ২৩ জুলাইয়ের ঘটনা এটি। সেই থেকে নিখোঁজ আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখার দশম শ্রেণির ছাত্র আবিদ। পরদিনই রামপুরা থানায় জিডি করেছিলেন আবিদের বাবা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত সৈয়দ রফিকুল ইসলাম। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো তথ্য দিতে পারেনি আজও। আবিদ জঙ্গিবাদের পথে পা বাড়িয়েছে—এমন সন্দেহ পরিবারের এবং এ জন্য তারা একটি কোচিং সেন্টারের দুই শিক্ষককে অভিযুক্ত করছে। ঘর ছাড়ার দিন আবিদ তার বাবার মোবাইল ফোন থেকে সব ছবি মুছে ফেলে; এ আচরণটিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও সন্দেহ, এই কিশোর উগ্রবাদীদের ফাঁদে পড়েছে। তাঁরা এর জন্য দায়ী করছেন দুই শিক্ষককে। এ ঘটনায় দায়ের করা জিডির একটি অনুলিপি দেওয়া হয়েছে র্যাবের কাছে। বিষয়টি জানানো হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই।
‘আমার ছেলে ছোট থেকেই লেখাপড়ায় মেধাবী ছিল। হঠাৎ কী যে হলো—লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে। তাহাজ্জুদের নামাজ পর্যন্ত পড়া শুরু করে। পরে যখন জানতে পারলাম, কোচিংয়ের উগ্রবাদী শিক্ষকরা তাকে মগজ ধোলাই করে জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত করেছে, আর কিছু করার ছিল না। একদিন ছেলেটি সবাইকে বোকা বানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়।’ কালের কণ্ঠকে বলেন আবিদের বাবা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে ওরা মগজ ধোলাই করে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে।’ ওরা কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বনশ্রীর একটি কোচিংয়ের শিক্ষক।’ কোন কোচিং জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশের নিষেধ আছে।
রফিকুল ইসলামের কথার সূত্র ধরে রামপুরা থানায় যোগাযোগ করা হয়। থানার ওসি (তদন্ত) কাজী শাহান হক বলেন, ‘হ্যাঁ ওই কোচিংয়ের নাম বলেছেন রফিকুল হক। তাঁর দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করছি। তদন্তে প্রমাণ হলে ওই কোচিংয়ের নাম প্রকাশ করা হবে।’ ছেলেটিকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে কি না তদন্তে তা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান ওসি।
আবিদ উগ্র চিন্তা থেকেই ঘর ছেড়েছে—এমন ধারণার আরো ব্যাখ্যা দেন তার বাবা। ‘বাসা ছাড়ার দিন ছেলে আমার মোবাইল ফোনে থাকা ওর (আবিদ) সব ছবি ডিলিট করে দেয়। বাসার আলমারির ড্রয়ার থেকে ১৯ হাজার টাকাসহ বাড়তি জামাকাপড় নিয়ে যায়।’ কালের কণ্ঠ প্রতিবেদককে বলেন রফিকুল হক। তিনি বলেন, ‘নিখোঁজ হওয়ার আগে আবিদের আচরণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছিল। কিন্তু আমরা গুরুত্ব দিইনি। আবিদ নিখোঁজ হওয়ার দিন সকাল ৮টায় আমি অফিসে চলে গিয়েছিলাম। ৯টার দিকে ওর মা-ও ছোট ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিতে বের হয়ে যায়। এর পরপরই বড় ছেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। সকাল ১১টায় আবিদের পরীক্ষা ছিল। পরে দেখা গেল ও পরীক্ষা দিতে যায়নি।’ রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখার দশম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ আবিদ হাসান রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকত। আবিদের মা খালেদা আক্তার গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আবিদ মেজ। তার বড় ভাই দেশের শীর্ষপর্যায়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আবিদ, ফাহিম, রিকি ও সিয়াম চার বন্ধু। তারা একসঙ্গে কোচিংয়ে প্রাইভেট পড়ত। ফাহিম বলেন, ‘আবিদ, রিকি ও সিয়াম আমরা বন্ধু। আমরা বনশ্রীর কোচিংয়ে একসঙ্গে প্রাইভেট পড়তাম। ওই সময় দুই শিক্ষক আমাদেরকে ক্লাসের পড়ার চেয়ে ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞান দিতে বেশি পছন্দ করতেন। দুই শিক্ষক আমাদেরকে জিহাদের কথা বলতেন। আইএসে যোগ দেওয়ার কথা বলতেন। তখনো আমরা জানতাম না যে আবিদ স্যারদের ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে। কারণ আবিদ খুব চাপা স্বভাবের ছিল।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অবিদের অন্য এক বন্ধু এ প্রতিবেদককে বলেন, সে সময় তাঁদের কোচিংয়ে বসিয়ে রেখে আবিদকে আলাদা রুমে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতেন শিক্ষক ইসরাক ও রায়হান। তবে কোচিংয়ের অন্য স্যাররা বলতেন, ‘তোমরা জিহাদে যাবা না।’ আবিদের বন্ধু রিকির মা নাহিদা মাসুদও বনশ্রীর একটি স্কুলের শিক্ষিকা। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আবিদ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে নিখোঁজ হওয়ার জন্য দায়ী কোচিংয়ের কতিপয় শিক্ষক।’
বনশ্রীর ওই কোচিং সেন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই কোচিংয়ের সন্দেহভাজন ওই দুই শিক্ষক রাজধানীর দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। একজনের নাম ইসরাক, অন্যজন রায়হান। এর মধ্যে ইসরাকের সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হয় কালের কণ্ঠ। ইসরাক বলেন, ‘সে সময় আমি বনশ্রীর ইকরা কোচিংয়ের শিক্ষক ছিলাম, এ কথা সত্য। সেই সঙ্গে আবির, ফাহিম, রিকি ও সিয়াম তখন ওই কোচিংয়ের ছাত্র ছিল। আমার ও রায়হানের ছাত্র ছিল, এসবই সত্য। কিন্তু আমি (ইসরাক) বা রায়হান তাদেরকে আইএস, জিহাদ বা জঙ্গিবাদ সম্পর্কে কোনো কথা বলিনি।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, উগ্র-মৌলবাদী গোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজনে কিশোর শিক্ষার্থীদেরও দলে ভেড়াচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম বলেন, কিশোরদেরও জঙ্গি সংগঠনগুলো ফাঁদে ফেলছে। তবে এ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর পাশাপাশি অভিভাবকদেরও সতর্ক হতে হবে।