Monday , 23 December 2024
সংবাদ শিরোনাম

ইসলামে ভালোবাসার মূল্যায়ন

যুগে যুগে প্রেমের পবিত্র সৌধের গাঁথুনি মজবুত করেছে : লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রজকিনী-চণ্ডীদাস, রাধা-কৃষ্ণের নানা উপাখ্যান। নিশীথ-কৃষ্ণকলি ‘লায়লা’র অনুরাগে শহরের দেয়াল বা কুকুরের গাল মজনুর কাছে প্রিয়তমার প্রতিচ্ছবি হলেও ‘সাইমুম (মরু) ঝড়ে’ চাপা পড়েছে তাঁদের প্রেমের সমাধি। ‘শিরিন’ বা শিরির ভাস্কর্য তৈরিতে অস্থির ফরহাদ আবেগের বশে পুরো পাহাড় কেটে প্রেয়সীর শত শত প্রতিরূপ দান করেও… শিরিকে পাওয়ার জন্য প্রমত্তা নদীতে বাঁধ গড়তে গিয়ে নিজেই তলিয়ে যান ভালোবাসার গভীর জলে। আঠারো সাল রহিমা বিবির অপেক্ষা বা ১২ বছর পড়শি থেকেও রজকিনী-চণ্ডীদাস প্রমাণ দিয়ে গেলেন প্রেমের সুখ প্রতীক্ষায়। এমনিভাবে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন আকাঙ্ক্ষায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেম তো স্বর্গীয় দ্যুতিতে চিরভাস্বর হয়ে আছে।

মানুষের মনোদৈহিক প্রবণতা ভালোবাসা : (ক) স্বভাবগত, (খ) গুণগত ও (গ) আদর্শগত কারণে হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমানদারের ভালোবাসা হতে হবে মহান আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর প্রতি নিবেদিত ও নিঃশর্ত। কেননা ভালোবাসার অপার শক্তিতে মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলা রক্ষা করেন। আবার মহান আল্লাহর করুণা নির্ঝরিণী বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাই মহান আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ভালোবাসার মূল্য বিপুল-বিশাল। ঈমানদারের ভালোবাসা প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের বাণী—আল্লাজিনা আমানু আশাদ্দু হুব্বালিল্লাহ—অর্থাৎ ‘মুমিনরা আল্লাহর ভালোবাসায় সুদৃঢ়।’ (সুরা বাকারা : ১৬৫) আবার আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার জন্যই ভালোবাসতে হবে প্রিয় নবীকে (সা.)। কেননা  মহান আল্লাহর বাণী : ‘(বলুন) যদি তোমরা আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তবে (আমি রাসুল) আমার আনুগত্য করো। তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১)

প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার কারণেই প্রিয়নবী (সা.)-এর নিদ্রা ভঙ্গের আশঙ্কায় হিজরতের সময় সাপের গর্তের মুখে পা চেপে রেখেছিলেন হজরত আবু বকর (রা.)। হিজরতের কঠিন সময়েও আমানতের মাল ফেরত দেওয়ার জন্য, মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত না হয়ে শত্রু পরিবেষ্টিত ‘নবীগৃহে’ বিছানায় শুয়েছিলেন আলী (রা.)। হজরত ওমর (রা.) চিৎকার করে বলেছিলেন—‘আমি আপনাকে জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।’ প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ও আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘তাবুকের যুদ্ধে’ আবু বকর (রা.) তাঁর সম্পদের সবটুকু এবং ওসমান (রা.) তাঁর সম্পদের অর্ধেক নিবেদন করেছিলেন। প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার কারণেই আবু হুরাইরা (রা.) পেটে পাথর বেঁধেও মসজিদে নববীতে অবস্থান করতেন। প্রিয়নবী (সা.)-এর কথা শুনতেন, তাঁকে (সা.) দেখতেন এবং তাঁকে (সা.) হুবহু অনুসরণ করতেন। আর প্রিয়নবী (সা.)-এর ওফাতে বেলাল (রা.) ‘নবীবিহীন’ মদিনা মেনে নিতে পারছিলেন না।

প্রিয়নবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করাই হলো তাঁর প্রতি ভালোবাসার উপায়। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না ‘আমি’ ভালোবাসার দিক থেকে তার পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততি অপেক্ষা অধিক প্রিয় (বিবেচ্য) না হব।’ (বুখারি ও মুসলিম)

প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ঈমানি পূর্ণতা ও পারলৌকিক মুক্তির শর্তে যুক্ত। প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রতি আবেগ ও আকর্ষণ এক অমূল্য অনুভূতি। আবার প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা, তাঁর আদর্শ অনুসরণের শিক্ষা ও পারলৌকিক সুখ-শান্তির নিশ্চয়তা দেয়। এ জন্যই প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘যে আমার আদর্শকে (সুন্নাহ) ভালোবাসল, সে যেন আমাকেই ভালোবাসল। আর যে আমাকে ভালোবাসল, সে আমার সঙ্গেই জান্নাতে বসবাস করবে।’ (মেশকাত) প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের বাণী—‘ঈমানদারদের কাছে তাদের জীবন অপেক্ষাও রাসুল অধিক প্রিয়।’ (সুরা আহজাব : ০৬) জৈবিক ভালোবাসা নয়, বরং ঈমানি-তাওহিদি ভালোবাসার বিশ্বাস, বাক্য ও ব্যবহারের দ্যুতিতে অন্ধকার হারিয়ে যাক সত্যের মোহনায়—এটাই ইসলামের আলোকিত ও শাশ্বত আহ্বান।

ভালোবাসা হলো আধুনিক প্রেমের কবির চিরন্তন কণ্ঠে প্রেয়সীকে  বলা—‘পৃথিবীর কাছে তুমি হয়তো কিছুই নও, কিন্তু কারো কাছে তুমিই তার পৃথিবী।’ কারণ ভালোবাসা একটি স্বর্গীয় অনুভূতি। অন্য কথায়, হৃদয়ের কথা বলার ব্যাকুলতায়—‘প্রাণ, মন, দেহ’ প্রেমাস্পদের কাছে সঁপে দেওয়ার নিঃশর্ত অভিব্যক্তি ও সাহসী আবেগ যার ফলে অস্তিত্ব ও অধিকার সৃষ্টি হয়, তার নাম ‘ভালোবাসা’। একটি ইংরেজি প্রবাদ : Love means not having to say you are sorry. মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে সম্মান জানিয়ে ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে রোম সম্রাট জেলুসিয়াস ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেনটাইনস ডে’ ঘোষণা করেন, বর্তমানে যা ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। প্রচলিত রোমান লোককথায় আছে, সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস তাঁর সৈন্যদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ করলে এক প্রেমানুরাগী যাজক গোপনে সৈন্যদের বিয়ে দেওয়া শুরু করেন। সম্রাট তাঁকে কারাগারে পাঠান। কিন্তু যাজকের সেবা, ভালোবাসা ও চিকিৎসায় ‘কারাপ্রধান’ আস্ট্রেরিয়াসের কন্যার অন্ধত্ব দূর হয়। অন্যদিকে রাজনিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের অপরাধে যাজকের হয় মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুর আগে মেয়েটিকে ওই যাজক যে শেষ বার্তা পাঠান, তা হলো—Love from your ‘Valentine’। ঘটনাটি ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২৭০ খ্রিস্টাব্দের।

বস্তুত নিছক একটি দিবস পালনের সীমাবদ্ধ আবেগ বা বিদেশি সংস্কৃতির সঙ্গে আপস রফার নাম ভালোবাসা নয়। ভালোবাসার চেতনা একটি সার্বক্ষণিক বিষয় ও ঈমানদারের ভালোবাসা হতে হবে মহান আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসারে। এতেই ইসলামের আলোকিত ও শাশ্বত আহ্বান ধ্বনিত হলেও ভালোবাসার লৌকিক উচ্চারণ শোনা যায়—

‘ঋণচিন্তা রোগচিন্তা সংসারচিন্তা সকল চিন্তা দর যৈবনকালে পীড়িতচিন্তা সকল চিন্তার বড়।’ (মৈমনসিংহ গীতিকা)

তবে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আমরা এমন কিছু সমর্থন করব না, যাতে—

♦ অবাধ্যতা-অশ্লীলতার জন্ম হয়।

♦ নারী নির্যাতন ও জঘন্য পাপাচারের পথ দেখায়।

♦ পর্দার মতো ফরজ বিধানের প্রতি অবজ্ঞা ও লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে।

♦ সময়-অর্থের বিপুল অপব্যয় ঘটে।

♦ ইবাদতবিমুখ চেতনার কারণে মানুষের পাপবোধ লোপ পায়।

♦ পারিবারিক বন্ধন লোপ পায় ও পারস্পরিক দায়িত্ববোধ ভুলে রঙ্গ-তামাশা বৃদ্ধি পায়।

♦ আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নের আশঙ্কা, ঝুঁকি ও অপরাধপ্রবণতা তৈরি হয়।

♦ বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ ও পৃষ্ঠপোষকতা হয়।

♦ দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা, আবহমান দেশীয় সংস্কৃতিবিমুখ প্রজন্ম তৈরি হয়।

♦ বেহায়াপনার মহড়ায় উঠতি তারুণ্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নিজের, পরিবার ও সমাজের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top