জাল ঘিরে রেখেছে বাড়ি ফেরার পথ। পদে পদে বাচ্চা সমেত ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। তাই সমুদ্রে না ফিরে মিষ্টি পানিতেই ছানা-পোনা নিয়ে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ওরা। পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার কিছু অংশে এ ভাবেই ইলিশদের স্থায়ী ভাবে থেকে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে বলে মৎস্যবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ দাবি করছেন। এই মাছেদের ‘আবাসিক ইলিশ’ গোত্রে ফেলছেন তারা। কলকাতাভিত্তিক আনন্দবাজার পত্রিকার পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য দেয়া হয়েছে।
মৎস্যবিজ্ঞানীদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা, হুগলির শ্রীরামপুর থেকে বলাগড় ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়চক থেকে ডায়মন্ড হারবার হয়ে নিশ্চিন্দাপুর পর্যন্ত নদীর কিছু কিছু জায়গায় ইলিশের বসবাস গড়ে উঠেছে বলে চিহ্নিত করা গিয়েছে। সারা বছর মিষ্টি পানিতেই থাকা-খাওয়া, প্রজনন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে এই ইলিশেরা। আর এদের যে সমস্ত বাচ্চা মিষ্টি পানিতেই বড় হয়ে উঠছে, তাদেরও সমুদ্রের প্রতি কোনও টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
ভারতের সরকারি তথ্য বলছে, সারা বছর কম-বেশি ১৪ হাজার ট্রলার লম্বা-লম্বা জাল নিয়ে মোহনা চষে বেড়ায়। ইলিশের মরসুমে এক একটা ট্রলারে এক থেকে দেড় টন করে ইলিশ ধরা পড়ে। জাল ফাঁকি দিয়ে সমুদ্র থেকে মিষ্টি পানিতে ঢুকে ডিম পাড়ার কাজটা কেউ-কেউ করতে পারলেও বহু ইলিশ তার আগেই ধরা পড়ে যায়। আবার ফেরার সময়েও একই ‘বিপদ’।
মৎস্যবিজ্ঞানী অমলেশ চৌধুরীর ব্যাখ্যা, মিষ্টি পানিতে ডিম পাড়ার পরে ইলিশের ঝাঁকের যখন সমুদ্রে ফিরে যাওয়ার কথা, সেই সময়ে তারা মোহনায় পৌঁছে জালে ধরা পড়ে যাচ্ছে। ফলে মোহনায় গিয়েও পিছু হটে চলে আসছে অনেকে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে এ ভাবেই কিছু মাছ নদীর মিষ্টি পানিতে রয়ে যাচ্ছে বলে গবেষণায় জানা গিয়েছে। অমলেশবাবুর দাবি, সম্পূর্ণ বিপরীত পরিবেশে মানিয়েও নিচ্ছে এই ইলিশেরা। এ পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার মতো বাংলাদেশের পদ্মা এবং মেঘনা নদীর কিছু কিছু অংশেও ইলিশ সারা বছর বংশবিস্তার করছে বলে জানান তিনি।
বছরখানেক ধরে ভারত-বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে ইলিশের এই ‘আবাসিক গোষ্ঠী’ নিয়ে গবেষণা করেছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’-এর উদ্যোগে ইলিশের উপরে সেই গবেষণা চালানো হয়। তাতে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বরিশালের কাছে চাঁদপুরেও সারা বছর এই ধরনের ইলিশের বসবাস তৈরি হয়েছে। পুরুলিয়ার সিধু-কানহু-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞানী অসীমকুমার নাথ ইলিশের ‘আবাসিক গোষ্ঠী’ নিয়েই গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, ‘‘শ্রীরামপুর থেকে বলাগড় অঞ্চলে সারা বছরই বিভিন্ন মাপের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। ছোট বাচ্চাও যেমন ধরা পড়ছে, ৪০০-৫০০ গ্রামের ইলিশও গঙ্গার বিভিন্ন অঞ্চলে জেলেদের জালে উঠছে। যেগুলি আর নোনা পানিতে ফিরে যায়নি।’’
কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণা সংস্থার মুখ্য বিজ্ঞানী বিজয়কালী মহাপাত্র জানাচ্ছেন, বহু বছর আগে গুজরাতের তাপ্তী নদী ধরে কিছু ইলিশ মাছ উকাই জলাধারে এসে আর ফিরে যায়নি। সেই জলাধারের মিষ্টি পানিতেই তারা থাকতে শুরু করে, ডিম পাড়ে এবং বাচ্চাও হয়। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, গুজরাতের ওই ইলিশ এবং পশ্চিমবঙ্গের ইলিশ একই প্রজাতির। যে মানসিকতা নিয়ে তারা উকাইতে থাকতে শুরু করেছিল, এখানেও একই চরিত্র ইলিশের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে বলে তিনি জানান।
পশ্চিমবঙ্গ সংগঠিত মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিজন মাইতি বলছেন, ইদানীং গঙ্গার কিছু কিছু অংশে সারা বছরই মৎস্যজীবীরা ইলিশ পাচ্ছেন। ওজনে ছোট হলেও রায়চক, নিশ্চিন্দাপুর, ডায়মন্ড হারবার অঞ্চলে জাল ফেলে অন্যান্য মাছের সঙ্গে দু’চারটে করে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন তিনিও।