নির্ভুল বানানসহ মানসম্পন্ন বই প্রকাশে ভালো সম্পাদনার বিকল্প নেই। তবু প্রকাশনা ব্যবসায় এ দিকটিতে সবচেয়ে কম মনোযোগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ সম্মাদনা-সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, বানান ঠিক করার জন্য কম টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেটিও সময়মতো পরিশোধ করা হয় না। এছাড়া কম সময়ে বেশি কাজ করতে বাধ্য হওয়ায় বানানও শতভাগ নির্ভুল করা সম্ভব হয় না। এতে প্রকাশনার মান পড়ে যায়। এছাড়া বানানরীতি মেনে ভাষার ব্যবহার মিলিয়ে বাক্য ঠিক করার কাজটি প্রুফরিডাররা করলেও সম্মানী বাবদ যা পান, তার পরিমাণ বলতেও বিব্রত বোধ করেন তারা। এমনকি এই সামান্য পরিমাণ টাকাও মেলার আগে মেলেই না বলে জানান তারা। বাকিতে কাজ করে দিতে হয় পরিচিত প্রকাশকদের। এতে ফাঁকির খাতাও ভারী হতে থাকে মেলা শেষে।সম্পাদনা-সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সম্পর্কের খাতিরে নির্ধারিত সময়ে বই প্রকাশ নিশ্চিত করতে বানান দেখে দিলেও মেলা শেষে টাকা আদায়ের জন্য বার বার প্রকাশকের দুয়ারে ঘুরতে হয়। বিপরীতে প্রকাশকরা বলছেন, প্রকাশনা ব্যবসায়ে থাকতে চাইলে প্রুফরিডারের টাকা মেরে দেওয়া সম্ভব নয়। হয়তো কখনও-কখনও দেরি হয় মাত্র, কিন্তু ফাঁকি দেওয়ার রেওয়াজ নেই বললেই চলে।কয়েকজন প্রুফরিডারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি ফর্মায় (১৬ পৃষ্ঠা) ৭০/৮০টাকা থেকে দুই শ/আড়াই শ টাকায় বানান দেখানোর প্রবণতা বেশি। এছাড়া বড় যে দুই-একটি প্রতিষ্ঠান নিঁখুত কাজ করতে চায়, তারা ফর্মা প্রতি একহাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে থাকে। বইমেলার সময়ই বইয়ের চাপ বেশি থাকে বলে প্রকাশকরা খুব বেশি দামাদামি করেন না কিন্তু বেশিরভাগ কাজ বাকিতে হয়। প্রকাশনা সংস্থাগুলোর ধরাবাঁধা প্রুফরিডার বা সম্পাদনার কোনও লোক নেই।একটি জাতীয় দৈনিকে সাহিত্য বিভাগে কাজ করেন অতনু তিয়াস। পুরো কাজটির সঙ্গে জড়িতদের প্রফেসনালিজমের অভাব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কেবল বানান ঠিক করা কোনও কাজ নয়। পুরো বইটি একই শৈলীতে লেখা কিনা, লেখায় একই টোন আছে কিনা, এসবও ঠিক করতে হয়। কিন্তু সেই কাজের সম্মানী বা সম্মান কোনোটিই দেওয়ার প্রবণতা নেই। তাই কেউ কেবল বানান দেখাতে চাইলে বলি, আমি দেখি না। তিনি আরও বলেন, ‘সম্পাদনা ক্ষেত্রে ফর্মাপ্রতি দাম নির্ধারণ করা হয়।’ সেই দাম সঠিক সময়ে পরিশোধ হয় কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে অতনু বলেন, ‘বাকি এবং ফাঁকি দুই-ই আছে।’জিয়াউর রহমান একটি পত্রিকায় প্রুফ সেকশনে কাজ করার পাশাপাশি বইয়ের প্রুফ দেখার কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘বইমেলার পাণ্ডুলিপি এমন সময়ে আসে যে, বানান দেখার জন্য সবচেয়ে কম সময় দেওয়া হয়। ধরুন বইটির প্রচ্ছদ হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ দিন ধরে। কয়েক দফায় প্রকাশক লেখক প্রচ্ছদশিল্পীর মধ্যে কথাও হচ্ছে। কিন্তু প্রুফ দেখার ক্ষেত্রে দশফর্মা পাঠিয়ে এক রাতেই শেষ করতে তাগাদা আসে। আর সেই সময়ের মধ্যে দিতে অস্বীকৃতি জানালে পরের কাজটি আপনি পাবেন না। এই শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে গিয়ে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ ভুল থেকে যায়।’ তিনি বলেন, ‘প্রকাশনার ওপর আস্থা হারানোর জন্য ভুল বানানই যথেষ্ট, এটি আমাদের মাথায় থাকে না।’দীর্ঘদিন প্রুফের কাজ করছেন আশরাফুল ইসলাম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কাজটি যাকে-তাকে দিয়ে করানো হয়। বাংলা বাজারে তো কোনও পেশাদার লোককে দিয়ে এ কাজ করানোর চলই নেই।’ তিনি বলেন, ‘একটি দুই শ পৃষ্ঠার বই প্রিন্ট না নিয়ে যখন আমি কেবল স্ক্রিনে দেখছি, তখন ভুল থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর প্রিন্ট নিয়ে দেখে আবার সেটা ইনপুট দেওয়ার মতো সময় থাকে না। যদি আমাদের বেশি টাকা দেওয়া হতো, তাহলে আমাকে এত বই হাতে নিতে হতো না। আর মানও ভালো হতো। সম্পাদনা না থাকায় ওই কাজটিও আমাদের করতে হয়। কিন্তু এটি আমাদের কাজ নয়। সময় কম দিয়ে, টাকা কম দিয়ে বা টাকা পরিশোধ না করে ভালো কাজের আশা করা ঠিক নয়। প্রকাশকরা প্রয়োজনীয় সময়ও দিতে রাজি নন। দশ ফর্মার বই পড়তেও তো দুই দিন সময় লাগে, সেখানে মাত্র ১২ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়।’এদিকে প্রকাশক রবিন আহসান বলেন, ‘প্রুফ যারা দেখছেন, তাদের আপনি টাকা না দিয়ে কোথায় যাবেন? পরের বছর নতুন কাউকে দিয়ে কাজ করাবেন? ফলে তাদের টাকা হয়তো কখনও দিতে দেরি হয়, পেশাদার প্রকাশকরা এটা মেরে দিতে চাইবে তা মনে হয় না।’সম্মানী বাকি ও ফাঁকির অভিযোগ অস্বীকার করে প্লাটফর্ম প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী হেলাল উদ্দিন হৃদয় বলেন, ‘সম্মানীর টাকা প্রুফ বুঝে পাওয়ার পরপরই পরিশোধ করা হয়। তবে কখনও কখনও দেরি হয়। ক্ষেত্রে আমরা আগেই কথা বলে নেই।’ প্রুফ দেখার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া প্রসঙ্গে হেলাল বলেন, ‘আমরা যথেষ্ট সময় দেই তাদের। যারা পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে চান, তারা অবশ্যই সম্মানী দেন এবং যথাসময়েই দেন।’ ফাঁকি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না বলে মন্তব্য করেন এই প্রকাশক।
নির্ভুল বানানসহ মানসম্পন্ন বই প্রকাশে ভালো সম্পাদনার বিকল্প নেই
Share!