রাথমিকে পড়ুয়া শিশুর শরীরের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহন নিষিদ্ধ করতে উচ্চ আদালত ৩০ দিনের মধ্যে সব স্কুলে সার্কুলার জারির জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিলেও নির্ধারিত সময় পরও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এমনকি এ ব্যাপারে ছয় মাসের মধ্যে আইন প্রণয়নে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ফাইলবন্দি। ফলে শিক্ষাদ-ের ভারে অবুঝ শিশুর মেরুদ- ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি আগের মতোই রয়ে গেছে।এদিকে দূর ভবিষ্যতেও শিশুর স্কুলব্যাগের ভার কমানোর বাস্তবমুখী কোনো উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান শিক্ষাবিদরা। এ নিয়ে আইন প্রণয়নের বিষয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন তারা। তাদের ভাষ্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুর বইয়ের বোঝা কমানো অসম্ভব। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতনতারও যথেষ্ট অভাব আছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় শুধুমাত্র সার্কুলার জারির মধ্যদিয়ে তাদের দায় সেরেছে। তবে এ নির্দেশনা আদৌ কেউ মানছে কিনা তা তদারকিরও কোনো পদক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্টদের। জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাসিম আহম্মেদ যায়যায়দিনকে বলেন, আদালতের রায়ের পর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেশের অধিকাংশ প্রাথমিক বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি স্কুলগুলোতে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। এ ধরনের নির্দেশনা আগে থেকেও ছিল। আদালতের রায়ের পর আরও জোরদার করা হয়েছে।
তবে এ নির্দেশনা মানা হচ্ছে কিনা বা মনিটরিংয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তার জবাব এড়িয়ে নাসিম আহম্মেদ বলেন, ‘এটি জোর করে বাস্তবায়নের চেয়ে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বাস্তবায়নেই সরকার বেশি মনোযোগী। এছাড়া এটি মানা বা না মানার বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভর করে অভিভাবক ও শিক্ষকদের ওপর। তাদের গাইড বইয়ের সংখ্যা কমানোর কথা বলা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ও বয়সানুপাতের বাইরে বই সিলেবাসে না রাখারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরকার, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সমন্বয়েই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে।’
আদালতের রুলিংয়ের ছয় মাসের মধ্যে আইন প্রণয়নের যে আদেশ ছিল সে বিষয়ে কতদূর অগ্রগতি হয়েছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইন করার জন্য আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি হাতে পেতে হয়। কারণ আদালতের রায়ে বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা, নজির ও দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হয়। সেসব বিষয় প্রাথমিক রায়ে উঠে আসে না। এ কারণে আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারব।’
এদিকে শিশুর স্কুলব্যাগের ভার কমাতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কথিত জোরালো নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কতটা মানছে সরেজমিন তা অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। রাজধানীর খ্যাতনামা স্কুল রাজউক, ভিকারুননিসা নূন, মতিঝিল আইডিয়াল, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার ও সাউথ পয়েন্ট স্কুলসহ ডজনখানেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, বছরের শুরুতেই শিশু শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে গত বছরের মতোই ভারী বইয়ের বোঝা রয়েছে। কোনো স্কুলেই বইয়ের সংখ্যা কমানো হয়নি; বরং দু-একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা আরও বেড়েছে।
এসব স্কুলের প্রথম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী চার থেকে সাড়ে চার কেজি ওজনের স্কুলব্যাগ বহন করছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রছাত্রীকে পাঁচ কেজি এবং চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণির সাড়ে ছয় থেকে সাত কেজির স্কুলব্যাগ টানতে হচ্ছে। এর ওপর যাদের ক্লাস শেষে বাধ্যতামূলকভাবে স্কুল কোচিংয়ে অংশ নিতে হয় তাদের ব্যাগে থাকা গাইডবইসহ অন্যান্য নোটের ওজন স্বাভাবিকভাবেই আরও এক দেড় কেজি বেশি।
অন্যদিকে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ঘাড়ে আরও এক থেকে দেড় কেজি বেশি বোঝা থাকছে। তবে এ ওজনের সঙ্গে স্কুলব্যাগ, পানির পাত্র ও টিফিনবক্সের ভারও যুক্ত রয়েছে।
অথচ প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গড় ওজন ২৫ কেজির ঊধর্ে্ব নয়। ১০ শতাংশ হিসেবে এ শ্রেণির শিক্ষার্থীর আড়াই কেজি ওজনের স্কুলব্যাগ বহন করার কথা। অথচ তাদের এর প্রায় দ্বিগুণ ভার টানতে হচ্ছে। অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরও দেড় থেকে তিনগুণ বেশি বই-খাতার বোঝা বহন করতে দেখা গেছে। বিষয়টি খোদ সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলোর প্রধানসহ অন্য শিক্ষকরা নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষালয়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতাকেও দায়ী করেন তাদের কেউ কেউ।
অথচ খোদ প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীই পাঠ্যপুস্তকের ভার শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য সহনীয় বলে দাবি করেছেন। গত ২৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজীর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রাক-প্রাথমিক স্তরের দুটি বইয়ের ওজন ৫১২ গ্রাম, প্রথম শ্রেণির তিনটি বইয়ের ওজন ৫২৫ গ্রাম, দ্বিতীয় শ্রেণির তিনটি বইয়ের ওজন ৫২৫ গ্রাম, তৃতীয় শ্রেণির ছয়টি বইয়ের ওজন ১ কেজি ১৫৬ গ্রাম, চতুর্থ শ্রেণির ছয়টি বইয়ের ওজন ১ কেজি ৩৫০ গ্রাম এবং পঞ্চম শ্রেণির ছয়টি বইয়ের ওজন ১ কেজি ৫০৪ গ্রাম।’
পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা কমানো প্রসঙ্গে মন্ত্রী জানান, প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক বাড়ানো বা কমানোর বিষয়টি কারিকুলাম পরিবর্তন-পরিমার্জন সম্পর্কিত। কারিকুলাম সংশোধনের বিষয়টি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বই বাড়ানো বা কমানো বিষয়ে এনসিটিবি ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।’
মন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যে হতাশা প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদদের অনেকেই। তাদের ভাষ্য, ‘মন্ত্রী শুধু বইয়ের ওজন দেখিয়ে নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। অথচ তিনি নিজেও ভালো করে জানেন, বইয়ের সঙ্গে খাতা-কলম, পানির বোতল, টিফিনবক্স ও ব্যাগের ওজনও শিক্ষার্থীদের বহন করতে হয়।’ তার এ বক্তব্য স্কুলব্যাগের ভার কমানোর উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
এ প্রসঙ্গে উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের ভাষ্য, সিলেবাসের বাইরে অতিরিক্ত বই নিষিদ্ধ এবং স্কুলে বিশুদ্ধ খাবার পানি নিশ্চিতকরণসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে স্কুলব্যাগের ভার কমানোর উদ্যোগের পরিবর্তে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে শিশু বিশেষজ্ঞদের অভিমত, শিশুর কাঁধে অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয়ার দায় কার কিংবা তা কমানোর উদ্যোগ কে নেবে এ বিতর্কে সময় যত গড়াচ্ছে, আগামী দিনের স্বপ্ন ততই ফিকে হয়ে আসছে। অতিরিক্ত বোঝায় শিশুর মেরুদ- ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞ শিশু চিকিৎসকরা জানান, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন হওয়া উচিত সর্বোচ্চ ১ কেজি। তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণির দুই কেজি, পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণির চার কেজি এবং অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির ব্যাগের ওজন হওয়া উচিত সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি।
প্রি-স্কুল সময় থেকেই শিশুর মেরুদ- ক্রমশ বিকাশ লাভ করতে থাকে আর ঠিক তখনই শিশুর কাঁধে একটি স্কুল ব্যাগ চাপিয়ে দেয়া হয়- যা রীতিমতো অন্যায় উল্লেখ করে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন, খালি চোখে এ ক্ষতির ভয়াবহতা পরিমাপ করা যাবে না। তবে গেলে কোনো অসচেতন বাবা-মা এ ভুল করতেন না।
অতিরিক্ত ভার বহনের ফলে স্কুল থেকে ফিরে অধিকাংশ শিশুই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে; খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা এমনকি বিনোদনেরও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। যা মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।
শিক্ষাবিদরা বলেন, কোন বয়সে কোন উচ্চতার শিশুদের সর্বাধিক কতটা ওজনের স্কুল ব্যাগ বহন করা উচিত তা নির্দিষ্ট করে দেয়ার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা জরুরি। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে শিক্ষক, অভিভাবক, স্কুল পরিচালন কমিটির সদস্যদের বাধ্যতামূলকভাবে সচেতন করে তুলতে হবে। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের স্কুলব্যাগ বহন করা একেবারেই নিষিদ্ধ করে তাদের ব্যাগ স্কুলেই রাখার ব্যবস্থা করা জরুরি। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ নিয়ম মেনে চলবে না তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে হবে।
এদিকে বাংলা মিডিয়ামের পাশাপাশি ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও একই আইনের আওতায় আনা জরুরি দাবি করে শিক্ষাবিদরা বলেন, সেখানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা এ দেশেরই ভবিষ্যৎ, তাই তাদের বিষয়ে বিশেষ মহলের আলাদা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ না রাখা উচিত। ইংরেজি মাধ্যমেই বইয়ের বোঝা বেশি তাই তাদেরই সবার আগে নিয়মনীতির গ-িতে বাধা জরুরি বলে মন্তব্য করেন শিক্ষাবিদরা।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রাথমিকে শিশুর শরীরের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহন নিষিদ্ধ করতে ছয় মাসের মধ্যে আইন প্রণয়নের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহন না করতে এবং করাতে বাংলা ও ইংরেজি মাধ?্যমের সব স্কুলে ৩০ দিনের মধ্যে একটি সার্কুলার জারি করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়। এ বিষয়ে গত বছর জারি করা একটি রুল নিষ্পত্তি করে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেয়।
বেশি ওজনের ব্যাগ বহন নিষিদ্ধ করতে উচ্চ আদালত ৩০ দিনের মধ্যে সব স্কুলে সার্কুলার জারি
Share!