প্রাচীনকালের মানুষ জানত যে খাবার পাকস্থলীতে গিয়ে হজম হয়। তাই শিকার শেষে পশুর পাকস্থলীতে একবার না তাকিয়ে পারত না তারা। সেখানে খুঁজে পাওয়া যেত না কোনো খাবার। পাওয়া যেত দলা জাতীয় কিছু। মনে হতো খাবার রান্না হয়েছে। পাকস্থলীতে আসলে কী হতো, এটা পুরোপুরি জানতে মানুষের প্রায় হাজার বছর লেগেছিল।তাপমাত্রার প্রভাবে খাবারের চেহারার পরিবর্তন হতো না। প্রাণিজগতের সদস্যদের শরীরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দেখা যায় ৩৮-৪৩ সেন্ট্রিগ্রেড, যা খাবার রান্নার জন্য যথেষ্ট নয়। পাকস্থলীতে গিয়ে খাবার হজম হয় ডাইজেস্টিভ জুসের মাধ্যমে যেখানে থাকে নানারকমের বিশেষ এনজাইম। মানুষ ও পশুর এলিম্যান্টারি ট্রাক্টকে একটা জটিল রাসায়নিক গবেষণাগারের সঙ্গে তুলনা করা চলে। খাবার খাওয়ার পর সেটা শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে। তারপর সেই খাবারের সঙ্গে মেশে নানারকমের ডাইজেস্টিভ জুস। তারপর খাবার এক অংশ থেকে আরেক অংশে যাওয়া শুরু করে। এরপর শুরু হয় হজমের কাজ। এ সময়ে জটিল রাসায়নিক যৌগগুলো পরিণত হয় সহজ-সরল রাসায়নিক যৌগে, যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়। শরীর যা হজম করতে পারে না বা যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় নয়, সেটা শরীর থেকে বের হয়ে আসে। মানুষের পাকস্থলীতে খাবার যে প্রক্রিয়ায় হজম হয়, সেটা সহজে বোঝা যায়নি বা ব্যাখ্যা করা যায়নি। এ ব্যাপারে রুশ বিজ্ঞানী আইভান পেট্রোভিচ পাভলভ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করেছেন। তিনিই প্রথম মানুষের প্রধান এলিম্যান্টারি গ্ল্যান্ডগুলো নিয়ে বিস্তারিত পরীক্ষা চালান। তিনি দেখান যে, গ্ল্যান্ডের সংখ্যা অনেক। এ গ্ল্যান্ডগুলো বিশেষ বিশেষ খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় ডাইজেস্টিভ জুস উৎপন্ন করে। এ গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান। ফলে খাবার কিভাবে হজম হয়, এ প্রশ্নের ওপর যে রহস্যময় পর্দা এতদিন ঝুলে ছিল, তা তিনি উঠিয়ে ফেলেন। খাবার হজমের প্রক্রিয়াটি তার পরও মানুষ পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। গবেষণাগারে টেস্ট টিউবে হজমের প্রক্রিয়াটি মানুষ ঘটাতে পারেনি। টেস্ট টিউবে প্রয়োজনীয় ডাইজেস্টিভ জুস মিশিয়ে খাবার হজম করা যায়নি। অথবা খাবার হজম হয়েছে, কিন্তু সময় লেগেছে অনেক। এ রহস্যের সমাধানে আবারো এগিয়ে এলেন রুশ বিজ্ঞানীরা। তারা খেয়াল করলেন যেসব খাবার ক্ষুদ্রান্ত্রের সংস্পর্শে আসে, সেগুলো খুব সহজেই হজম হয়। যেমন_ প্যানে কোনো রান্না করতে গেলে দেখা যায় প্যানের সংস্পর্শে যে খাবার আসে সেটাই তাড়াতাড়ি সিদ্ধ হয়। খাবারের চেয়ে প্যানের গায়ের তাপমাত্রা থাকে অনেক বেশি। কিন্তু ক্ষুদ্রান্ত্রের সে রকম তাপমাত্রা থাকে না। তাহলে আসল ব্যাপারটি কী? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে প্রথমেই জানতে হবে ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়াল কি খাবার হজমের ব্যাপারে সহযোগিতা করে? এ প্রশ্নটা মাথায় রেখে একটা পরীক্ষা করা হলো। একটা পশুর শরীরের ক্ষুদ্রান্ত্রের একটা অংশ কাটা হলো। তারপর সেটা রাখা হলো একটা টেস্ট টিউবে। টেস্ট টিউবে আগেই রাখা ছিল স্টার্চের মিশ্রণ ও অ্যামিলেইস। ফলে খাবার হজম দ্রুত হলো। এ পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হলো যে ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়াল খাবার হজমের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু কিভাবে? এবার এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হলো। অনেক গবেষণা হলো। কিন্তু সমাধান পাওয়া গেল আচমকা। ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়ালের গঠনের মাঝে লুকিয়ে আছে আসল রহস্য। ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়াল বা উপরি অংশ তৈরি এপিথেলিয়াল সেল দ্বারা। এসব সেলে আছে প্রচুর পরিমাণ অতি ক্ষুদ্র শুট (ংযড়ড়ঃ)। প্রতিটি কোষে থাকে প্রায় ৩ হাজারের মতো শুট। এর ফলে ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়াল থেকে বের হয় প্রয়োজনীয় এনজাইম। আবার এসব কোষেই জমা থাকে প্রয়োজনীয় এনজাইম। খাবার হজমের প্রক্রিয়ায় এ এনজাইমগুলো ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ খাবার হজমের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এনজাইম না থাকলে খাবার হজম হতো অনেক সময় নিয়ে। ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়ালের যেসব জায়গায় এনজাইমের ঘনত্ব বেশি হয়, সেখানে খাবার দ্রুত হজম হয়। এনজাইমের সংখ্যা বেশি থাকে না; কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, একই ধরনের এনজাইম বার বার ব্যবহার করা যায়। দুটো স্তরে খাবার হজম হয়। প্রথম স্তরে খাবার এলিম্যান্টারি স্ট্রাক্ট দিয়ে পার হয় যেখানে খাবার দলায় পরিণত হয়। এখানে এনজাইমের ঘনত্ব কম থাকে। হজমের প্রাথমিক কাজটা এখানে শুরু হয়। খাবারের দলাটা প্রথমে ছোট ছোট দলায় পরিণত হয়। তারপর পরিণত হয় আলাদা আলাদা অণুতে। হজমের দ্বিতীয় স্তরে এ অনুগুলো ভাঙতে শুরু করে। এ সময়ে খাবার ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রবেশ করে এবং ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়ালের পাশে এসে দ্রুত হজম হয়। হজমের এ প্রক্রিয়াটা মানুষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে প্রয়োজনীয় এনজাইম পাওয়া যায়। তাই বেশি পরিমাণ খাবার এখানে খুব অল্প সময়ে হজম হতে পারে। আবার বিরতি দিয়ে এনজাইম বের হতে পারে। যেসব এনজাইম ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়ালে জমা থাকে সেগুলো অনেক দিন ধরে ব্যবহার করা যায়। হজমের এ স্তরে খাবার পুরোপুরি হজম হয়। হজমকৃত খাবারের পুষ্টি রক্তে গিয়ে মেশে। আর এ কাজটা হয় ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়ালের পাশেই। ফলে খাবার থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি হারিয়ে যাওয়ার আগেই রক্তে মিশতে পারে। হজমের এ প্রক্রিয়াটা এখান থেকে একটু দূরে হলে মানুষের শরীরের জন্য হতে পারত ক্ষতিকারক। এটা যেন একটা নিখুঁত রাসায়নিক গবেষণাগার। এখানে সবকিছুই একটা সুন্দর নিয়ম মেনে চলছে।মানুষ অসুস্থ হয়। অসুস্থ মানুষের অনেকের আবার এ সময় এলিম্যান্টারি গ্ল্যান্ড প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এর ফলে হজমের কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। এটা এক রহস্য যা মানুষ এখন বুঝতে পারে। ত্রুটিপূর্ণ গ্ল্যান্ট থেকে যে এনজাইম বের হয় তার পরিমাণ হয় অল্প। কিন্তু সেটা জমা থাকে ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়ালে। ফলে এলিম্যান্টারি গ্ল্যান্ড বন্ধ হয়ে গেলেও হজমের কাজটা পুরোপুরিই চলে।
বিস্ময়কর গবেষণাগার পাকস্থলী
Share!