হারিয়ে যাচ্ছে শিশু চলচ্চিত্র ও গান। গত কয়েক বছরে কোনো শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। তারই ধারাবাহিকতায় তৈরি হয়নি কোনো গান। ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’ সেই গানটা আজও শিশুদের কাছে সমান সমাদৃত। কিন্তু এই প্রজন্মের শিশুদের জন্য কোনো গানই এখন তৈরি হচ্ছে না- এমন আক্ষেপ প্রকাশ করেন অনেকেই। প্রযোজক সমিতির তথ্য মতে, ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ৫৫। আর ২০১৫ সালে এই সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে ৭৩ এর কোঠায়। তবে ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ (১৯৮০), ‘দীপু নাম্বার টু’ (১৯৯৬), ‘দূরত্ব’ মতো শিশুতোষ চলচ্চিত্রগুলোর ন্যায় একটি শিশুতোষ ছবিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি চলতি বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রগুলোতে শিশুদের কোনো গান নেই। অথচ একসময় শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে ৫০টির বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন। এ ছাড়া পরবর্তী সময়েও শিশু অভিনয়শিল্পীর জন্য আরও কিছু গানে গলা মিলিয়েছেন তিনি। অতীত-বর্তমান মিলিয়ে নিজের অনুভূতি জানিয়ে এ গুণী ব্যক্তিত্ব বলেন, ছোটবেলায় বহু ছবিতে আমি গান করেছি। পরবর্তী সময়েও কিন্তু গেয়েছি। আসলে তখন ছবিতে এ ধরনের গল্প থাকত। যার ফলে গান গাওয়ার সুযোগ তৈরি হতো। কিন্তু এখন কি এমন ছবি তৈরি হচ্ছে? একটা ছবিতে শিশুদের গান থাকতেই হবে, এমন কোনো যৌক্তিকতা না থাকলেও। কিন্তু চলচ্চিত্র বেশ বড় মাধ্যম। শিশুর বিকাশে যা আমরা কাজে লাগাতে পারি।সাবিনা ইয়াসমিন আরও বলেন, পাশ্চাত্যের অনেক দেশে মিউজিক্যাল ছবি তৈরি হচ্ছে, বিশেষ করে ত্রিমাত্রিক ছবি। আমাদের দেশে তো এটা ভাবাই যায় না। আর এগুলো কিন্তু শিশুরা বেশ পছন্দ করে। তাই এগুলো নিয়ে ভাবা উচিত। কারণ আমাদের এখানে শিশুদের বিনোদনের মাধ্যম সীমিত। তাদের জন্যও চলচ্চিত্র নির্মাণ খুব জরুরি।সনামধন্য সংগীত পরিচালক শেখ সাদী খান। সব ধরনের গানের মধ্যে তিনি শিশু কণ্ঠের গানও সুর করেছেন। তার ভাষ্য, ‘বাংলা চলচ্চিত্রে শিশু শিল্পীর জন্য গান তৈরি না হওয়ার অন্যতম কারণ এখন শিশুতোষ ছবিই নির্মাণ হচ্ছে না। আর ছবি নির্মাণ না হওয়ার জন্য আমাদের সমাজব্যবস্থাও দায়ী। শিশুদের জন্য তৈরি হচ্ছে না আলাদা কোনো গল্প। শুধু ভাবা হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সস্তা বিনোদনের কথা। ফলে কাহিনীকারও গল্প সাজাচ্ছেন সেভাবে। যেখানে শিশু চরিত্র কমে যায়। তাই একজন সংগীত পরিচালকের গান তৈরির কোনো সুযোগও থাকে না। আবার হয়তো ব্যবসার দিকও বিবেচনা করা হতে পারে। কারণ এখন আইটেম গানের চলটা বেশ চলছে। একটা আইটেম গান করলেই আলাদাভাবে কাভারেজ পাওয়া যায়। গান হিট হলেই ভাবা হয় চলচ্চিত্র হিট। তাই বাণিজ্যিক ছবি নির্মাতাদের মাথায় এখন শিশুতোষ গানের চেয়ে আইটেম গানের চিন্তাটা ঢুকে গেছে। তাই নির্মাতাদের এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ এখন ছবি মুক্তি পায় কিন্তু শিশুতোষ ছবি বা শিশুশিল্পীর গান তৈরি হয় না।’চিত্রনির্মাতা মোর্শেদুল ইসলাম জানান, ‘শিশুদের জন্য নির্মিত চলচ্চিত্র বা গান তাদের কল্পনার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। তাই গান বা ছবির বিষয়বস্তু নির্বাচন এ ক্ষেত্রে বেশ জরুরি। তাই আগামী ২৬ ডিসেম্বর থেকে আমি একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্রের শুটিং শুরু করতে যাচ্ছি। তবে ছবিটির বিষয়ে এখনই কিছু বলতে চাইছি না।’গান শিশুকে সৃষ্টিশীল হয়ে উঠতে সহায়তা করে বলে জানালেন সংগীত পরিচালক ইমন সাহা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এ শিল্পী স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি কিন্তু ছোটবেলায় সিনেমা হলে যেতাম। তখন থেকে আমার মনে হতো আমি যদি ‘অমুকের’ মতো হতে পারি। এ ধরনের আগ্রহ তখনই হবে, যখন একজন শিশুর হলে যাওয়ার মতো আগ্রহ থাকে। যখন দেখবে তার মতো একজন গান গাইছে, সে কিন্তু তখন গায়ক বা অভিনেতা হতে চাইবে। তাদের কল্পনার জগত খুলে যাবে। এমনটা তো আমারই হয়েছে। ছোটবেলায় আমি ভাবতাম বড় পুরস্কার মানে বিরাট ব্যাপার। একদিন বড় দা পুরস্কার নিয়ে বাসায় এলেন। আর আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম আমিও সংগীত পরিচালক হব। ঘোষণা দিলাম, বড়দার চেয়েও বড় পুরস্কার আমি ঘরে আনব। যার সাইজ হবে আলমারির মতো! শিশুরা কিন্তু এখন এই অনুপ্রেরণার জায়গা পাচ্ছে না। এটা নিয়ে ভাবা উচিত। আর শুধু শিশুতোষ ছবি কেন, এমনিতেই সাধারণ ছবিতে গান নিয়ে কাজ করার সুযোগ থাকে। শুধু ছবির পরিচালককে সে ধরনের গল্প বাছাই করতে হবে।
হারিয়ে যাচ্ছে শিশু চলচ্চিত্র ও গান
Share!