দুই সপ্তাহ আগেও ঢাকার খুচরা বাজারে আলুর দর ছিল কেজিপ্রতি ১৮-২০ টাকা। এখন তা চলছে ৩২-৩৪ টাকা কেজি।কেবল পুরনো আলুর এ দর। তবে নতুন আলুর দর একেক বাজারে একেক রকম। কোথাও ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়, কোথাও ১৫০ টাকা। আবার কোথাও পাওয়া যায় ১০০ টাকার কমে। ব্যবসায়ীরা জানায়, শুরুতে নতুন আলুর দাম বরাবরই এমন হয়। সেটা নিয়ে তাদের চিন্তা নেই, তবে চিন্তা হচ্ছে পুরনো আলু নিয়ে। নতুন আলু পুরোদমে বাজারে চলে আসার আগেই পুরনো আলুর মজুদ শেষ না করে ফেলতে পারলে মহাবিপদে পড়তে হবে নতুন ও পুরনো দুই আলু নিয়েই। আর এ বিপদ আঁচ করতে পেরেই মজুদদাররা পুরনো আলুর দাম বাড়িয়ে মুনাফা তুলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।বাংলাদেশ আলু রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশন (বিপিইএ) সূত্রে জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদিত হয় প্রায় ৯৭ লাখ টন, যার ৪০ শতাংশই হিমাগারে মজুদ রাখতে হয়। চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ১৫ লাখ টন আলু থেকে যায় উদ্বৃত্ত।এত আলু উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে আলু রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তা সুবিধা কমিয়ে দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এ উদ্বেগ থেকেই তারা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এরই মধ্যে সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে আলু রপ্তানিকারকদের আগে ১৬ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হলেও এখন তা কমিয়ে ১০ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।২০১৪ সালে দেশের একটি গ্রুপের পক্ষ থেকে রাশিয়ায় পাঠানো আলুতে ভাইরাস ধরা পড়ায় বাংলাদেশ থেকে আলু আমদানি নিষিদ্ধ করে দেয় দেশটি। এখনো ওই নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে। ‘আলুর দাম লাফিয়ে বাড়ছে। দুই সপ্তাহ আগে পাইকারি দর ছিল প্রতি কেজি ১৫-১৬ টাকা। এখন পাইকারি দর ২৫-২৬ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সামনে দাম আরো বাড়ে না কমে, বোঝা যাচ্ছে না। তবে কমার লক্ষণ দেখছি না। এবার সাত কানি জমিতে (স্থানীয়ভাবে ১৪০ শতাংশ জমিকে এক কানি বলা হয়) আলু চাষ করছি। পানি দেরিতে নামায় আলু চাষের ক্ষেত তৈরি করতেও দেরি হয়েছে। সাত বছর ধরে নিয়মিত আলু চাষ করছি। গত বছর জমি থেকে আলু বিক্রি করেছি মণপ্রতি ৪২০ টাকা দরে। কিন্তু এবার আগেভাগেই শোনা যাচ্ছে নতুন মৌসুমের আলুর দাম পড়ে যেতে পারে। পুরনো আলুর মজুদই এখনো শেষ হয়নি। দাম গত বছরের চেয়েও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছি। ’একাধিক কৃষিবিদ জানান, নতুন আলু বাজারে আসার সময় এখনো হয়নি। কোথাও কোথাও এখনো চাষাবাদ প্রক্রিয়া চলছে। নতুন বলতে বাজারে যতটুকু পাওয়া যায়, তা আগাম ফসল হিসেবে কেউ কেউ চাষ করে। আর মৌসুমি আলুর বাম্পার ফলনে ক্ষেতের পর ক্ষেত ভরা এবার। এমন ফলন দেখে শুরুতে কৃষকের মুখে হাসি দেখা গেলেও আলু তোলার সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই ভর করছে বিষাদের ছায়া। শঙ্কায় ভুগতে শুরু করেছে কৃষক থেকে শুরু করে আলু ব্যবসায়ীরাও। কী হবে এত আলু দিয়ে! উদ্বৃত্ত আলু কী ২০০৭ সালের মতো আবার ক্ষেতেই পচবে? উৎপাদন খরচ উঠবে তো? এমন নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তাদের মনে।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের উপরিচালক (মনিটরিং) ড. মোহাম্মদ আবদুহু কালের কণ্ঠকে জানান, গত মৌসুমে দেশে চার লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ করে ৯৪ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়। এবারও একই পরিমাণ জমিতে আবাদ এবং একই পরিমাণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সে অনুসারে আলু চাষ প্রায় শেষ পর্যায়ে। জানুয়ারির শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে ওই আলু উত্তোলন করা হবে। তবে যেসব এলাকায় আগাম চাষাবাদ হয়েছে, সেখানকার আলু আগেভাগেই বাজারে এসে যাবে।আলুর এমন ভালো ফলনের পরও কেন উৎকণ্ঠা জানতে চাইলে দেশের আলু ব্যবসায়ীদের শীর্ষপর্যায়ের নেতা ড. ফেরদৌসী বেগম বলেন, দেশে উৎপাদিত এই একটি পণ্যই সবচেয়ে বেশি উদ্বৃত্ত থাকে। বলা যায়, চাহিদার দ্বিগুণ উৎপাদিত হয়ে থাকে। এবার এই ফলন আগের তুলানায় আরো বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটাই একটা বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে কৃষক ও ব্যবসায়ী উভয় পক্ষের জন্যই।ওই ব্যবসায়ী আরো বলেন, ‘উদ্বৃত্ত আলু রপ্তানির ক্ষেত্র বাড়ছে না বরং কমছে। আমাদের কোনো কোনো ব্যবসায়ীর অসর্তকতা ও অনৈতিক মুনাফা আয়ের লোভের খেসারত দিতে হচ্ছে সবাইকে। বিশেষ করে আলু রপ্তানির সবচেয়ে বড় একটি সুযোগ এসেছিল রাশিয়া থেকে। কিন্তু উদ্বৃত্ত আলুর প্রায় অর্ধেক পরিমাণ রপ্তানির পথ তৈরি হওয়ার পর, ২০১৪ সালে দেশের একটি গ্রুপ থেকে রাশিয়ায় যে আলু পাঠানো হয়েছিল তাতে বিশেষ ভাইরাস ধরা পড়ে। ফলে বাংলাদেশ থেকে আলু আমদানি নিষিদ্ধ করে দেয় রাশিয়া। দুই বছর ধরে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা পদক্ষেপ নিয়েও ওই নিষেধাজ্ঞা তোলা সম্ভব হয়নি। যদিও রাশিয়ার পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, মানসম্পন্ন ও রোগ-জীবাণুমুক্তসহ প্রয়োজনীয় সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হতে পারে। ’সম্প্রতি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিপিইএর মহাসচিব জাকির হোসেন বলেন, ‘রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তা কমিয়ে ফেলা হলে আলু রপ্তানি করা সম্ভব হবে না বরং এ খাতে বড় রকমের ধস নামবে। তাই আমরা সহায়তা কমানোর পরিবর্তে বরং তা বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার সুপারিশ করছি। ’ ওই ব্যবসায়ী নেতা আরো বলেন, উদ্বৃত্ত আলু রপ্তানি করতে না পারলে হিমাগারের খরচ বেড়ে যাবে এবং কৃষক পরে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবে।সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আলু রপ্তানিকারক অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভারত সরকার সে দেশের আলু রপ্তানিকারদের ৩০ শতাংশ, পাকিস্তানে ৩৫ ও চীনে ২০ শতাংশ হারে নগদ অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ সহায়তা বাড়াতে হবে।বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে ১৫ জাতের আলু চাষ হয়। এর বাইরে সম্প্রতি বিদেশ থেকে আরো কয়েকটি জাতের নমুনা আনা হয়েছে। তবে আলুর জাতের পাশাপাশি এখানে এর রোগের মাত্রাও বেশি। ফলে বাংলাদেশের আলুর প্রতি অনেক দেশেরই এক ধরনের অনীহা রয়েছে। বাংলাদেশ সাধারণত নেপাল, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কায় বেশি আলু পাঠায়।
নতুন আলুর দর একেক বাজারে একেক রকম
Share!