গত ২৪ নভেম্বর মেয়েদের বিয়ের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছর করার বাধ্যবাধকতা রেখে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন করার প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। তবে এই আইনের ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, বিশেষ ক্ষেত্রে অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশনাক্রমে মাতা-পিতার সমর্থনে বিয়ে হলে এ আইনের অধীনে অপরাধ হবে না। কিন্তু ১৮-এর নিচে কত বছর বয়সে বিয়ে হতে পারে, আইনে তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই। এ কারণে বিশেষ এই বিধানটি বাল্যবিবাহের প্রবণতা বাড়িয়ে দিবে বলে মনে করছেন নারী নেতৃবৃন্দ ও মানবাধিকার কর্মীরা। আর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, বিশেষ বিধানে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করা হয়েছে।এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ইত্তেফাককে বলেন, আমরা কি পিছিয়ে যাচ্ছি? ১৯২৯ সালে ১৮ বছর রাখা হলে এখন তা আবার কেন বিশেষ বিধান রেখে ১৮ এর নিচে করা হবে। বিয়ের বয়স ১৮ বছর রেখেই বাল্যবিবাহ কমানো যাচ্ছে না। এই অবস্থায় এই বিশেষ বিধান বাল্যবিবাহকে উত্সাহিত করবে এবং তা আরো বাড়িয়ে দিবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত শতকরা ৬৫ জন শিশুর বিয়ে হয় ১৬ বছরের আগে। শিশু বিয়ের মধ্যে শতকরা ৫.৭৯ ভাগ বিয়ে হয় প্রেম করে, তবে বাবা-মার অনুমতি সাপেক্ষে আর মাত্র ১.৫ ভাগ শিশুর বিয়ে হয় বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক অথবা পালিয়ে যাওয়ার কারণে। এছাড়া বাল্যবিবাহ হওয়া মেয়েদের মধ্যে ৬৩.৭৪ শতাংশই শিক্ষার্থী, যাদের বিয়ে হওয়ার কারণে শিক্ষা জীবনের অবসান হয়েছে।‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’র কর্মসূচি সমন্বয়ক আব্দুল্লাহ আল মামুন ইত্তেফাককে বলেন, বাবা-মা’র সম্মতিক্রমে ১৮ বছরের নিচে বিয়ে দেয়ার বিষয়টিতে আমাদের আপত্তি রয়েছে। কারণ আমাদের বাবা-মায়েরা দরিদ্র, অসচেতন ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। তারা এই ধারার জন্য ১২/১০ এমনকি ৮ বছরের মেয়েকেও বিয়ে দিয়ে দিবে। তিনি বিশেষ ধারাটিতে শুধুমাত্র ‘আদালতের আদেশক্রমে’ বিধান রাখার আবেদন জানান।বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স কমালে দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে নারীর যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা বাধাপ্রাপ্ত হবে। শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু বাড়বে। ধারাটি নারী উন্নয়ন নীতিসহ অনেক আইন ও নীতিমালারও পরিপন্থি বলে তিনি মনে করেন।এ বিষয় জাতীয় কন্যা শিশু এডভোকেসি ফোরামের সাধারণ সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি ইত্তেফাককে বলেন, নারী ক্ষমতায়নে বড় অন্তরায় বাল্যবিবাহ। প্রস্তাবিত আইনে বিশেষ প্রয়োজনে ১৮ এর নিচে বিয়ের বয়স রাখার সমালোচনা করে তিনি বলেন, বয়সের এই পরিবর্তন সরকারের বাল্যবিবাহ কমিয়ে আনার লক্ষ্যের বিপরীতে কাজ করবে। যা অনেক ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহকে উত্সাহিত করবে। এটি শিশু নীতি ও শিশু আইন বিরোধী বলেও তিনি মন্তব্য করেন।তবে বিশেষ বিধান প্রসঙ্গে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম দাবি করেছেন, ‘বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৬’ এর বিশেষ বিধানকে ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আইনের বিশেষ বিধানে বলা আছে-শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশেষ ক্ষেত্রে বিয়ের বয়স ১৮’র নিচে বিবেচনা করা যাবে। শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বলতে কী বোঝানো হয়েছে তা বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে স্পষ্ট করা হবে। এই আইনটি অন্য যে কোনো আইনের তুলনায় শক্তিশালী। এ আইনে বাল্যবিবাহ সম্পাদনে জড়িত সকল পক্ষের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বিবাহ এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ বন্ধের অঙ্গীকার রয়েছে সরকারের।
Share!