Monday , 23 December 2024
সংবাদ শিরোনাম

হজের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, মহান আল্লাহর সন্তোষ অর্জন করে ইহ-পরকালীন জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করা

হজ মূলত তখনই কবুল হবে বলে আশা করা যায়, যখন ব্যক্তি হালাল খাদ্য ভক্ষণসাপেক্ষে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বন করে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অতিক্রম করার জন্য দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে কালাতিপাত করবেন হজ ইসলামের অন্যতম বুনিয়াদ। বিত্তবান সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মুসলিম নর-নারীর ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ করা হয়েছে। পৃথিবীর মুসলিমদের মহাসম্মেলন এ হজ অগণিত ভাষাভাষী মানুষের ভাষার বাঁধ ভেঙে ফেলে। এশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকা থেকে আগত ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’। লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত এ বুলন্দ আওয়াজ বাতাসে ঢেউ তুলে ছড়িয়ে পড়ে চার দিকে। সাদা-কালো কিংবা বাদামি রঙের মানুষের দেহে থাকে পবিত্রতার প্রতীক শুভ্র পোশাক। অবর্ণনীয় কষ্ট ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে হজ সম্পন্ন করে ফিরে আসেন হাজীরা স্বদেশে। স্বভাবতই প্রত্যেক হাজী সাহেবের কাছ থেকে কাম্য একজন প্রকৃত মুসলমানের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। হজের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে- মহান আল্লাহর সন্তোষ অর্জন করে ইহ-পরকালীন জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করা। হজ মূলত তখনই কবুল হবে বলে আশা করা যায়, যখন ব্যক্তি হালাল খাদ্য ভক্ষণসাপেক্ষে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বন করে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অতিক্রম করার জন্য দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে কালাতিপাত করবেন। পৃথিবীর লাখ লাখ লোক প্রতি বছর হজ পালন করেন। সবার মধ্যে যদি তাকওয়া সৃষ্টি হতো, তবে নিশ্চয় সমাজজীবনেও তার প্রতিফলন ঘটত। ফলে জগৎজুড়ে একটি ইসলামি বন্ধনের শক্তি গড়ে উঠত। পরকালের সঞ্চয় হতো, আর ইহকালেও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব হতো। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি তা দেখতে পাচ্ছি? নিশ্চয় আমাদের কোথাও-না-কোথাও কিছু ত্র“টি রয়েছে, যা সংশোধন হওয়া বাঞ্ছনীয়।বনি আদমের সন্তান সবাই সমান, অহঙ্কারের কোনো অবকাশ নেই। শ্বেতশুভ্র দুই টুকরো কাপড় গায়ে জড়িয়ে এ কথার স্বীকারোক্তি দিয়েই হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু। মিনায় তাঁবুজীবন, আরাফাতের বিশাল প্রান্তরে অবস্থান, মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন, আবার মিনাতে প্রত্যাবর্তন, জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ, মিনায় পশু কোরবানি, আবার কাবা শরিফ তাওয়াফ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড মানুষকে শেখায় উদার হতে, নিজের পশুত্বকে বিসর্জন দিতে, অশুভ শক্তি তথা শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। শেখায় কষ্টসহিষ্ণু, সুশৃঙ্খলা ও সবর অবলম্বনের মাধ্যমে যেকোনো বিপদ মোকাবেলা করতে। কিন্তু অনেকেই হজ থেকে ফিরে এসে ভুলে যান সে কথা। পার্থিব মোহে জড়িয়ে পড়েন পাপিষ্ঠ শয়তানের ধোঁকায়। হজের মূল উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে আবার জড়িয়ে পড়েন আত্মপ্রবৃত্তির অনুসরণে, সুদ-ঘুষ ইত্যাদি নিষিদ্ধ কাজে তথা পাপপঙ্কিলতার আবর্তে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সঙ্কল্প নিতে হবে হজের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে।মক্কা থেকে উত্তরে অনেক দূরত্বে অবস্থিত মদিনা মুনাওয়ারা। এটি ছিল মহানবী সা: কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রের রাজধানী। মসজিদে নববীতে বসে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতেন। হজে আসা ব্যক্তিরা মদিনাতে এসে মসজিদে নববীতে সালাত আদায় করার অপূর্ব সুযোগ হাতছাড়া করেন না। তদুপরি এ মসজিদের গা ঘেঁষে অবস্থিত মহানবী সা:-এর রওজা মোবারক। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর উদ্দেশে সালাম ও দুরুদ পাঠের যে বিরল সুযোগ তাও তারা হাতছাড়া করেন না। পরিতাপের বিষয়- হজ থেকে ফিরে আমরা অনেকেই ভুলে যাই মহানবী সা: প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করতে। অনেকেই মনেপ্রাণে মহানবী সা:-কে নবী হিসেবে মেনে নিলেও রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার পরিচালনায় তিনি যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তা সেকেলে মনে করে বাস্তবায়নে অনাগ্রহ প্রকাশ করি। মহানবী সা:-কে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী হিসেবে মনে করলেও তাঁর সুন্নাতগুলো নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নে অনীহা প্রকাশ করি। মহানবী সা: পরকালীন জীবনের কঠিন মুহূর্তে একমাত্র সুপারিশকারী হবেন এ কথা জেনেও আমরা অনেকেই ধর্মীয় অনুশাসন উপেক্ষা করে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি, যা হজের মূল উদ্দেশ্যকে চরমভাবে ব্যাহত করে। খুলাফায়ে রাশিদিনের শাসনকালে হজের সময় রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে নিযুক্ত গভর্নররা হজ শেষে মদিনায় এসে আমিরুল মুমিনিনের সাথে সাক্ষাৎ করতেন, শাসিত অঞ্চলের বিভিন্ন বিষয় তাঁকে অবহিত করতেন এবং তাঁর নির্দেশনা নিয়ে নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে যেতেন। আজো যদি হজে আগত মুসলিম রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা মক্কা কিংবা মদিনায় একত্র হয়ে মুসলিম উম্মাহর সমস্যাগুলো নিয়ে মতবিনিময় করেন এবং অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেরা উপকৃত হয়ে নিজ নিজ দেশে তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন, তবে এটি হতো মুসলিম দেশগুলোর জন্য বহুমাত্রিক কল্যাণের মধ্যে একটি, যার প্রভাব অনিবার্যরূপে সদূরপ্রসারী। প্রত্যেক হাজীই হজের সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে জেনেই হজ পালন করার উদ্দেশে মক্কা শরিফ যান। সেখানে গিয়ে তারা কেউ মিথ্যে কথা বলেন না, ঝগড়া-বিবাদ করেন না, কারো সম্পদ কেউ আত্মসাৎ করেন না, কেউ কাউকে কষ্ট দেন না, কেউ কাউকে হত্যা করেন না, একে অন্যকে সাহায্য করেন, দীর্ঘ সময় ইবাদতে মশগুল থাকেন, নির্দিষ্ট কিছু হালাল কাজকেও হারাম করে নেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হজ শেষে কিছু দিন পর আবার পুরনো অভ্যাস মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। হজের মূল অর্জনকে ধরে রাখা প্রতিটি হাজীরই একান্ত কর্তব্য।হজ থেকে ফিরে এসে প্রতিটি হাজীর উচিত সেখানে যে আমলগুলো সম্পাদন করে এসেছেন তা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা। মনে রাখতে হবে- অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা, হাইজ্যাক করা, কাউকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া কবিরা গুনাহ। বিপদে একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে না আসা আল্লাহর বিধানের পরিপন্থী। টাকাপয়সা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় না করে নিজের নফসের সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করা মহান আল্লাহর সাথেই প্রতারণা করা। টাকা পয়সা রোজগারের ক্ষেত্রে হালাল-হারাম চিন্তা না করা ইবাদত কবুলের অন্তরায়, এক প্রতিবেশী থেকে অন্য প্রতিবেশী নিরাপদ না থাকলে সে প্রকৃত মুমিন নয়।
পরিতাপের বিষয় অনেক হাজীর ব্যক্তিজীবনে তো বটেই সমাজজীবনেও হজের শিক্ষার কোনো প্রতিফলন হয় না। আজ যদি প্রত্যক হাজী তাকওয়া অর্জন করত ও নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করত তবে ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন পাল্টে যেত। কারণ হজের প্রতিটি আহকামে, প্রতিটি গতিবিধিতে রয়েছে উৎসাহ ও প্রেরণা যা দ্বারা সম্ভব হচ্ছে বিশ্বমানবতার মিলন সেতু রচনা করা।মহানবী সা: হজের ফজিলাত এবং মহান আল্লাহর দরবারে তার উচ্চমর্যাদার কথা তুলে ধরেছেন অত্যন্ত তাকিদের সাথে। ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যে হজ করে এবং অশ্লীল কথা ও আচরণ থেকে নিজেকে হিফাজত করে সে এমন নিষ্পাপ হয়ে যাবে, যেমন সে ছিল মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভের দিন’ (মুসলিম)। মহানবী সা:-এর ইরশাদ হলো- ‘উত্তম জিহাদ হচ্ছে মকবুল হজ’ (বুখারি)।
প্রকৃতপক্ষে হজ একটি ঐতিহ্যবাহী অনন্য ফরজ ইবাদত ও বিশ্ব মুসলিম সম্মেলন। সব হাজীরই উচিত তাওহিদি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পরিপূর্ণভাবে মেনে চলা। শুধু পুলিশ বা কোনো বাহিনী দিয়ে সমাজে শান্তি আসবে না। না ব্যক্তিজীবনে, না সমাজে, না আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। বহুধাবিভক্ত মুসলিম সমাজ যদি আল্লাহর নির্দেশ ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জু একত্র হয়ে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো, আর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (সূরা ইমরান, আয়াত-১০৩)-এ নির্দেশ মেনে চলত, তাহলে সারা বিশ্বে আজ মুসলমানদের ওপর যে মুছিবত উপস্থিত হয়েছে তা হতো না। বরং বিশ্বমানব মুসলিম জাতিকে সমীহ করে চলত। তাই আর দেরি না করে আমাদের উচিত হজের শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করা। কবির ভাষায়-
‘ঘুমায়ে ক্বাযা করেছি ফজর
তখনো জাগিনি যখন যোহর
হেলায় ও খেলায় কেটেছে আসর
মাগরিবের আজ শুনি আযান
জামাত শামিল হওরে এশাতে
এখনও জামাতে আছে স্থান।’
মহান আল্লাহ মুসলমানদেরকে তাঁর রহমত থেকে নিরাশ না হতে বলেছেন। তাই প্রত্যেক হাজীর উচিত আন্তরিকতার সাথে হজের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তাঁর রহমত কামনা করা। নিশ্চয় তিনি আমাদের নিরাশ করবেন না। আমরা আশা করব, হজের শিক্ষা বাস্তবায়নে বিশ্ব মুসলিমের আধ্যাত্মিক-নৈতিক উন্নতি, সামাজিক, রাজনৈতিক সংহতি, অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি এবং আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় ইসলাম-মুসলিমের অবস্থান সুসংহত ও সৃদৃঢ় হবে ইনশাআল্লাহ।

 

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top