পাশ্চাত্যের সরকার ও গণমাধ্যমগুলো তাদের সমাজে মানুষের ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করলেও এ ধর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেনি বরং দিন দিন ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। পাশ্চাত্যে পুরুষদের চেয়ে নারীদের বেশি ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে গবেষণা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাশ্চাত্যের নারীরা যে পরিবেশে বড় হয় তাতে তারা সন্তুষ্ট নয়। নিজ ধর্মের ব্যাপারে অনীহার কারণেই মূলত তারা ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।বিশিষ্ট গবেষক এ্যালকোবাইতি নাওল বলেন, পাশ্চাত্যে বেশিরভাগ নারীর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পেছনে এমন বিশেষ অনুভূতি কাজ করে যা এ ধর্মের মধ্যে রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইসলাম ধর্মে একত্ববাদের কথা বলা হয়েছে কিন্তু খ্রিস্টানদের ধর্মবিশ্বাসে ‘ত্রিত্ববাদের’ কথা রয়েছে। ত্রিত্ববাদ বলতে এক ঈশ্বরের মধ্যে পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার মিলনকেই বোঝায়। বর্তমানে বেশিরভাগ খ্রীস্টানই স্রষ্টা সম্পর্কে এই ধারণা পোষণ করে। এই গবেষক পাশ্চাত্যে ইসলাম বিস্তারের জন্য রাজনৈতিক কারণকেও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় মুসলমানদের অভিযুক্ত করার এবং ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী প্রচারণা জোরদার হওয়ার পর আমেরিকার জনগণ বিশেষ করে নারীদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ অনেক বেড়েছে।বর্তমানে নারীরা কুরআন পড়ার পাশাপাশি ইসলাম নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করেছেন। তারা এখন বুঝতে পারছেন, পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোতে ইসলামে নারীদের অবস্থান নিয়ে যা বলা হচ্ছে তা মোটেও সঠিক নয়। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করে পাশ্চাত্যের নারীরা এটা বুঝতে পারছেন, ইসলামেই নারীর প্রকৃত স্বাধীনতা, মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।আজ আমরা যে নারীর কথা জানবো তার নাম সুসান কারল্যান্ড। জন্ম ১৯৮০ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের ফেরমন্ট এলাকায়। বর্তমানে মেলবোর্নের মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসাবে কর্মরত। এখান থেকেই ২০১৫ সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বিষয় ছিলো পাশ্চাত্যের মুসলিম নারীদের নেতৃত্বের বাধা। ২০০২ সালে বিয়ে করেন টিভি উপস্থাপক ওয়ালিদ আলীকে। তাদের দুই সন্তান আয়েশা (১২) ও যায়েদ (৯)। তিনি একাধারে সমাজকর্মী, টিভি উপস্থাপক । ২০০৪ সালে তিনি সেরা অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম নারী নির্বাচিত হন।মাত্র সাত বছর বয়সে তার পিতা-মাতা আলাদা হয়ে যান। তিনিমায়েরসঙ্গেথাকতেন,যিনি ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারি। এব্যাপারেসুসানকারল্যান্ড বলেন, আমার মা ইউনাইটেড চার্চে যেতেন এবং প্রতি সপ্তায় আমিও চার্চের সাপ্তাহিক ধর্মীয় আলোচনায় অংশ নিতাম। ১২ বছর বয়সে আমি সঙ্গীতের দিকে ঝুঁকে পড়ি এবং এ সময় ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে আমার মধ্যে কোনো আগ্রহ ছিল না। সে সময় আমি ধর্ম থেকে নিজেকে পুরোপুরি দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম।
সুসান কারল্যান্ড তরুণ বয়সে অনেক আনন্দ- উল্লাস করে সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু এত কিছুর পরও তিনি এক ধরনের শূণ্যতা অনুভব করতেন। সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস ও ধর্মের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উপলব্ধি করতেন। কারণ বস্তুগত সব সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ডুবে থাকলেও মনে প্রশান্তি ছিল না। এজন্য তিনি সব সময় সত্যের সন্ধানে ছিলেন। এ ব্যাপারে সুসান কারল্যান্ড বলেন, ১৭ বছর বয়সে ধর্ম নিয়ে নানা গবেষণা ও চিন্তা-ভাবনা শুরু করলাম। তবে আমার গবেষণায় ইসলাম ধর্মকে বাদ দিয়েছিলাম। কারণ আমি বিশ্বাস করতাম ইসলাম একটি সহিংসতার ধর্ম। তাই এ ধর্ম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করাকে আমি সমীচীন মনে করিনি। আমার মা ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে এতটাই খারাপ ধারণা পোষণ করতেন যে, তিনি বলতেন একজন মুসলমানের চেয়ে মাদক চোরাকারবারীকে বিয়ে করাই ভালো।কিন্তু তারপরও যেহেতু তিনি সত্যসন্ধানী ছিলেন তাই হয়ত আল্লাহতালাও তাকে সহযোগিতা করেছেন। তিনি ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর বুঝতে পারছিলেন না ইসলাম তাকে খুঁজে পেয়েছে নাকি তিনি ইসলামকে খুঁজে পেয়েছেন। ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখার পর কিছু কিছু পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও টেলিভিশনে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ জন্মে। ইসলাম সম্পর্কে যতই জানার চেষ্টা করি ততই উৎসাহ জাগতে থাকে ও আরো পড়াশুনা করতে উদ্বুদ্ধ হই। আস্তে আস্তে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আমার ধারণা পুরোপুরি পাল্টে যায়। বিশেষ করে ইসলামের একত্ববাদ আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে। কারণ খ্রিস্টানদের ধর্মবিশ্বাসে ‘ত্রিত্ববাদের’ যে কথা বলা হয়েছে তার কোনো যুক্তি নেই। অবশেষে ১৯৯৯ সালে ১৯ বছর বয়সে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সাধারণত যে কেউ নতুন মুসলমান হওয়ার পর প্রথমেই সে তার পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবের পক্ষ থেকে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা তাদেরকে প্রশান্তি যোগায়, যেকোনো বিপদ-আপদ ও কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্য ও সহ্য ক্ষমতা বাড়ায় এবং জীবনকে সহজ করে দেয়। কারণ তারা জীবনের লক্ষ্য-উদ্দশ্য সম্পর্কে জানেন। সুসান কারল্যান্ডও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর অনেক আপনজনকে হারিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে প্রিয়জনরা আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও আমি অনেক মূল্যবান জিনিস খুঁজে পেয়েছি। আমি মুসলমান হওয়ার সময় এ ব্যাপারটি আমার পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদেরকে অবহিত করি। আমি যে দিন মুসলমান হই সেদিন রাতে আমার মা শূকরের মাংস রান্না করেছিলেন। তিনি যখন শুনলেন আমি মুসলমান হয়ে গেছি এবং ইসলামে শূকরের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ তখন তিনি খুব কেঁদেছিলেনসুসান কারল্যান্ড ইসলাম গ্রহণের পর হিজাব ব্যবহার শুরু করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, হিজাব ব্যবহারের ফলে মনে হয়, আমি যেন আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেছি। কিন্তু হিজাবের কারণে অনেক কাছের মানুষও আমাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি এবং অনেকেই আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার কারণে পশ্চিমা দেশগুলতে প্রতিনিয়ত মুসলিমবিদ্বেষ বাড়ছে। এর ফলে মুসলিমদের নানা ধরণের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। সুসান কারল্যান্ডও এর ব্যাতিক্রম নন। ইসলাম সম্পর্কে কথা বলার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি একটি ম্যাসেজ পান, যাতে লেখা ছিলো একজন মুসলিম নারী হিসাবে তিনি নাকি হত্যা, খুন, যুদ্ধ, বহুবিবাহের মতো নির্যাতনকে ভালোবাসেন। এ বার্তায় যথারীতি তার মন খারাপ হয়। কিন্তু তখন তার কোরআন শরিফের একটি আয়াত মনে পড়ে, যেখানে ভালো কাজ দিয়ে মন্দ কাজকে মোকাবেলা করার কথা বলা হয়েছে।সুসান তখন সিদ্ধান্ত নেন তিনি যতগুলো হেট ম্যাসেজ পাবেন প্রতিটির জন্য এক ডলার দান করবেন।
Share!