আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জোরপূর্বক মানুষের কাছ থেকে আনুগত্য আদায় করে নিতে চান না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে মানবজীবন ও সমাজে কোনো বিধি কার্যকর করার মাধ্যমেও তিনি স্বীয় প্রভুত্ব কায়েম করতে চান না। আল্লাহ তায়ালার মহান ইচ্ছে ব্যক্তি চরিত্র শোধনের মাধ্যমে সমাজ সংশোধন করা। কারণ ব্যক্তি চরিত্রের অবক্ষয়ই সামাজিক অধপতনের মূল কারণ। অবক্ষয়ের মূল ছিদ্রপথ বন্ধ না করে প্রবাহের গতি বন্ধ করতে চাইলে তাতে হিতে বিপরীত ঘটার সম্ভাবনাই থাকে বেশি। তাতে সামাজিক অধঃপতনটাই তরাম্বিত হতে পারে। মহান আল্লাহ ব্যক্তি চরিত্র সংশোধনের যত কর্মসূচি দিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম সিয়ামে রমাজান। মূলত মানব মনের পাপ প্রবণতাই তার চারিত্রিক অবক্ষয়ের মূল কারণ। রমজান মাসের সিয়াম সাধনার আসল উদ্দেশ্য মুমিনের মন থেকে পাপের প্রবণতাকে একেবারে মুছে ফেলে দেওয়া। আর সে জন্য মহান আল্লাহ মুমিনের জন্য রমজান কেন্দ্রিক বেশকিছু কর্মসূচি দিয়েছেন।
শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা : পাপিষ্ঠ আজাজিল মহান আল্লাহর আদেশ অমান্য করার অপরাধে বিতাড়িত হয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার লানতের ভার কাঁধে নিয়ে শয়তান আখ্যায় পৃথিবীতে নেমে আসার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে আদম ও তাঁর সন্তানদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে আল্লাহর আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুৎ করবে। এরশাদ হয়েছে, ‘সে বলল : আপনি যখন আমাকে বিতাড়িত করলেন, আমি অবশ্যই তাদের জন্য আপনার সিরাতে মুস্তাকিমে বসে থাকব। অতঃপর তাদের প্রতারিত করব তাদের সামনের দিক থেকে, তাদের পেছনের দিক থেকে, তাদের ডান দিক থেকে এবং তাদের বাম দিক থেকে। সুতরাং আপনি তাদের অধিকাংশকেই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ পাবেন না। তিনি বললেন : তুই বের হয়ে যা এখান থেকে লাঞ্ছিত ও অপমাণিত হয়ে। তাদের মধ্য থেকে যে কেউ তোর অনুসরণ করবে, আমি তাদের দিয়ে অবশ্যই জাহান্নাম পূর্ণ করব।(সূরা আল-আরাফ : ১৬-১৮) শয়তান যাতে তার প্রতিজ্ঞা অনুযয়ী মুমিনকে প্রতারিত করতে না পারে সে জন্য মহান আল্লাহ রমজান মাসের প্রথম দিন থেকে শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে রাখেন, মুমিন বান্দাকে পাপাচার না করতে এবং পুণ্যর কাজ করতে অনবরত আহ্বান করতে থাকেন। হজরত উতবা ইবনে ফারকাদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি; রমজান মাসে জান্নাতের সব দরজা খুলে দেওয়া হয় আর জাহান্নামের সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে তখন বন্দি করে রাখা হয় এবং একজন ঘোষক প্রতি রাতে ঘোষণা করতে থাকেন, হে সৎকর্মপরায়ন! তুমি দ্রুত অগ্রসর হও আর হে পাপাচারি! তুমি থেমে যাও।(সুনানে নাসাঈ : ২১০৭, মুসনাদে আব্দুর রাজ্জাক : ৭৩৮৬, মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা : ৯৪১, মুসনাদে আহমাদ: ১৮৭৯৫, আস্-সুনানুল কুবরা : ২৪২৮, বায়হাকী শুআবুল ঈমান : ৩৩২৯)
মুমিন বান্দা যেন মরজান মাসে রোজা রাখার জন্য আন্তরিক সদিচ্ছার সম্পূর্ণটা উজাড় করে দেয় সে রোজার সীমাহীন ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, রোজার পুরস্কার আল্লাহ নিজে প্রদান করবেন, রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকে আম্বরের চেয়েও প্রিয়, রোজাদারের জন্য জান্নাতে বিশেষ তোরণ নির্মাণ করা হবে ইত্যাদি। আবার পুরস্কারর থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয় দেখিয়ে রোজার প্রতি মুমিনের আগ্রহকে আরো বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : বহু রোজাদার আছে যারা তাদের রোজার বিনিময়ে ক্ষুধা আর পিপাসার কষ্ট ছাড়া অন্য কিছুই পায় না। হাদিসটি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন।(সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৬৯০, মুসনাদে আহমাদ : ৯৬৮৫, সুনানে দারেমি : ২৭৬২, আস্ সুনানুল কুবরা : ৩২৩৬) বস্তুত রোজাদার রোজা রেখে দিনের বেলায় খাদ্য, পানীয় ও যৌনতা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তার বৈষয়িক জীবনের সব ক্ষেত্রে পাপাচার থেকে বিরত থাকার স্থায়ী অভ্যাস গড়ে তুলবে সে জন্যই মহান আল্লাহ রোজা ফরজ করেছেন। কিন্তু সে যদি রোজা রাখা অবস্থাতেই সুদ, ঘুষ, হারাম উপার্জনসহ অন্যান্য পাপাচার বর্জন করতে না পারে, তাহলে তার রোজা সম্পূর্ণই মূল্যহীন হয়ে যায়। তাই সব রোজাদারের অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সব পাপাচার থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন।