এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএ’র সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, দেশের যতগুলো পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে তার মধ্যে ৭০ ভাগই বন্ধ হয়েছে ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতার কারণে। ব্যাংকের উচ্চ সুদও কারখানা বন্ধ হওয়ার অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে একের পর এক কারখানা বন্ধ হওয়ায় এ খাতে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, বড় বড় ঋণ কেলেংকারির ঘটনা। বিশেষ করে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, মাদার টেক্সটাইল, মাদারীপুর স্পিনিং, বেনটেক্স, ফেয়ার গ্র“প, রানকা সোহেল কম্পোজিট টেক্সটাইলসহ ভুঁইফোড় শত শত প্রতিষ্ঠানকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ দিয়ে বিপাকে পড়েছে অন্তত ৩০টিরও বেশি ব্যাংক। এতে করে আশংকা করা হচ্ছে, এসব খেলাপি ঋণের বড় অংশ আর ফেরত পাবে না ওইসব ব্যাংক। প্রশ্ন হল- তাহলে কি হবে? ব্যাংক এসব টাকা আদায় করতে না পারলে নির্ঘাত তার পুঁজিতে টান পড়বে। এক পর্যায়ে যখন এ ধরনের খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়তে থাকবে তখন ওই ব্যাংকের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। ব্যাংক বিশ্লেষকদের অনেকে এখন এমন আশংকা করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৪ সাল শেষে খেলাপি ঋণের ১৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের। এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, পোশাক খাতসহ শিল্প খাতে ব্যাংকের ঋণ রয়েছে মোট ঋণের প্রায় ৩৭ শতাংশ।
সূত্র জানায়, চলতি বছর ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৫০ থেকে ৬০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সোয়ান, লিরিক, আরএম ফ্যাশন, মিফকিফ ও বনী। বন্ধের প্রক্রিয়ায় রয়েছে মিরপুরের লিবার্টি গার্মেন্ট, লিবার্টি ফ্যাশন ও উত্তরার ফাহিম লুমসহ ৩০-৪০টি কারখানা। এ ছাড়া কারখানা স্থাপন করেও গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়ায় অনেক কারখানা চালু করা যাচ্ছে না। আবার অতিমাত্রায় ব্যাংক সুদের কারণে লাভের মুখ দেখতে না পাওয়ায় অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগকৃত অর্থ আদায়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান হেলাল আহমদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বেশিরভাগ পোশাক শিল্পকেন্দ্রিক। স্বাভাবিকভাবে এ খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগও অনেক বেশি। তাই ঝুঁকিও বেশি। কিন্তু যারা জালিয়াতি করে ঋণ দিয়েছে তারা শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ক্ষতি করেনি, সামগ্রিকভাবে দেশেরও ক্ষতি করেছে।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে নিবন্ধিত পোশাক কারখানা ৫ হাজার ৯৯৯টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৯৩টিই বন্ধ হয়ে গেছে। এর বাইরে রুগ্ন হয়ে পড়ে আছে আরও ৪৩৯টি কারখানা। অবশ্য অন্য একটি সূত্র বলছে, বর্তমানে সারা দেশে তিন হাজারের মতো কারখানা চালু রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে পোশাক কারখানা ছিল ৫ হাজার ১৫০টি। ২০১১-১২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৪০০টি। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ছিল ৫ হাজার ৮৭৬টি। কিন্তু ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২২২।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনসে দুর্ঘটনার পর কমপ্লায়েন্স (তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ) ঘাটতি ও কার্যাদেশ বাতিলের অজুহাতে কারখানা বন্ধের তালিকায় ২০১৪ সালে যোগ হয়েছে ২২০টি। এতে বেকার হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক।এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে চলতি বছরে ৫০-৬০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর বাইরে বিজিএমইএ’র সদস্য নয় এমন আরও ৭শ’ থেকে ৮শ’ কারখানা হঠাৎ বন্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ক্ষতিতে থাকা ছোট-মাঝারি পোশাক কারখানাগুলোকে ব্যবসায় টিকিয়ে রাখতে ইউএসএইড, জাইকাসহ বিদেশী সংস্থাগুলো আইএলও আইন অনুযায়ী স্বল্প সুদে ঋণ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমরা বিদেশী ফান্ড ব্যবহার করে কিভাবে এ কারখানাগুলোকে সাহায্য করতে পারি তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করব।’জানা গেছে, ঋণের টাকা ফেরত না দেয়ায় ইতিমধ্যে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ৩৭ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকার মন্দ ঋণ (পুরাতন খেলাপি) অবলোপন করেছে (ব্যালান্সশিট থেকে বাদ দিয়েছে)। এর বাইরে আরও বেড়েছে খেলাপি ঋণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকিং খাতে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। বর্তমানে অবলোপন করা মন্দ ঋণ ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ যোগ করলে মোট খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯২ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে। এসব ব্যাংকের মোট ঋণের ২৪ দশমিক ৬৪ শতাংশই এখন খেলাপি। এরপরে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ২১ দশমিক ৮৪ শতাংশই খেলাপি ঋণ। বিদেশী ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ রয়েছে মোট ঋণের ৬ দশমিক ০৯ শতাংশ।