Monday , 23 December 2024
সংবাদ শিরোনাম

এবার নিজামীর জন্য অনুকম্পা ভিক্ষা

জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে অনুকম্পা চাইলেন তাঁর প্রধান আইনজীবী। গতকাল বুধবার আপিল বিভাগে শুনানিকালে নিজামীর আইনজীবী বলেন, ‘আদালত যদি মনে করেন নিজামীর যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়; তিনি অপরাধ করেছেন; আদালত যদি সাজা দেন, তাহলে তাঁর বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনা করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেবেন না বলে আশা করছি।’

শুনানিকালে নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘তখনকার (একাত্তরে) বাংলাদেশটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে ছিল। দেশের মানুষ সেনাবাহিনীর ভয়াবহ আতঙ্কে থাকত। ওই সময় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সত্য তবে তার সঙ্গে নিজামী জড়িত ছিলেন না।’ আদালতে খন্দকার মাহবুব আরো বলেন, ‘বদর বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী এবং জামায়াতে ইসলামীর সদস্য হিসেবে তাঁরা তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিশ্বাস করতেন। সেই বিশ্বাস থেকে পাকিস্তানি বাহিনী যারা এখানে ছিল, তাদেরকে তাঁরা মরাল সাপোর্ট দিয়েছেন; রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন।’

মৃত্যুদণ্ডের সাজার বিরুদ্ধে নিজামীর দাখিল করা আপিল

আবেদনের ওপর আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের শেষ দিনে গতকাল দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এসব কথা বলেন।

শুনানি শেষে আদালত থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি যা বুঝেছি, তাতে আমার মনে হলো, এই প্রথম একজন অভিযুক্ত নেতার পক্ষে তাঁর আইনজীবী অপরাধ স্বীকার করে নিলেন এবং শুধু মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আবেদন করলেন।’

তবে বিকেলে নিজামীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব সাংবাদিকদের বলেন, ‘দোষ স্বীকার করার প্রশ্নই আসে না। দোষ স্বীকার করলে তো আপিল করার প্রয়োজন ছিল না। দোষ স্বীকারের যে বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, তা সত্য নয়। এটা বিভ্রান্তিমূলক।’

গতকাল শুনানিতে আদালত বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদরসহ এ দেশীয় সহযোগীরা যদি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে না দিত, তবে ১০ মাস নয়, পাকিস্তানি আর্মি তিন মাসও থাকতে পারত না। এ দেশ থেকে তাদের পালাতে হতো।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চে গতকাল নিজামীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনে অ্যাডভোকেট মাহবুব হোসেনকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান ও মো. শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন সম্পন্ন হওয়ায় আগামী ৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের দিন ধার্য রয়েছে।

গতকাল শুনানির শুরুতেই খন্দকার মাহবুব হোসেন তাঁর লিখিত বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করেন। লিখিত কপি প্রত্যেক বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে দেওয়ার পর তিনি বলেন, নিজামীর বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ এবং লুণ্ঠনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য যে মামলার সাক্ষীদের দীর্ঘদিন সেফ হোমে রেখে প্রসিকিউটর (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এ কারণে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সাক্ষীরা একরকম বক্তব্য দিয়েছেন আর আদালতে এসে ভিন্নভাবে কথা বলেছেন।’

শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, ‘আপনারা মনে হয় মুজাহিদের রায় ফলো করেননি। ওখানে আমি সংক্ষিপ্ত করে বলে দিয়েছি।’ আদালত বলেন, কে মাহবুবে আলম এটা কি পাকিস্তান সেনাবাহিনী চিনত? পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীরা যদি চিনিয়ে না দিত, তবে তারা তো কাউকে চিনত না। তখন রাজাকাররা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সমর্থন না করলে সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান থেকে সেনারা এসে ১০ মাস থাকতে পারত না। স্থানীয় সহযোগীরা সহযোগিতা না করলে তিন মাসও থাকতে পারত না।

জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, তার পরও তখনকার বাংলাদেশটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে ছিল। দেশের মানুষ সেনাবাহিনীর ভয়াবহ আতঙ্কে থাকত। এ রকম আতঙ্কের সময় নিজামী ১৯ বছর বা ২০ বছরের একটি সাধারণ ছাত্র ছিলেন। ওই সময় প্রতাপশালী আর্মিকে সহযোগিতা করা বা তাদের বলা-এটা করো, ওটা করো, পথ দেখিয়ে দেওয়া-এই ক্ষমতা বা কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি তাঁর ছিল না। তিনি বলেন, চারটা চার্জে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। প্রসিকিউশন থেকে প্রমাণ করল ২৬ মে বা ৩০ মে আলবদর গঠন করা হয়। তিনি বলেন, এই বদর বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে করা হয়েছে। তিনি বলেন, দুই চার্জে আলবদর কমান্ডার হিসেবে নিজামীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। যখন আলবদর হয়নি তখন আলবদর কমান্ডার হিসেবে ফাঁসি দেওয়া আইনত সঠিক হয়নি।

খন্দকার মাহবুব বলেন, জামায়াতে ইসলামী এবং জামায়াতে ইসলামীর সদস্য হিসেবে তাঁরা তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করতেন। সেই বিশ্বাস থেকে পাকিস্তানি বাহিনী যারা এখানে ছিল তাদের তাঁরা মরাল সাপোর্ট দিয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন।

আদালত বলেন, আপনি যে ছিলেন তা ওই সময়ের পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে রয়েছে। এ সময় আদালত খন্দকার মাহবুবকে পেপারবুক থেকে পত্রিকার প্রতিবেদন পড়তে বলেন।

আদালত বলেন, বদর দিবসে উনি (নিজামী) বক্তব্য দিয়েছেন। বলেছেন, ‘রক্ত দাও, জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ো।’ যুদ্ধের শেষ দিকে যদি এসব কথা বলেন, এটা দেখে কি প্রমাণ হচ্ছে না যে উনি নেতা ছিলেন?

খন্দকার মাহবুব বলেন, ওই সময় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সত্য। তবে তার সঙ্গে নিজামী জড়িত ছিলেন না। তখন আর্মি এসেছে-এ কথা শোনামাত্র মানুষ দেশ-গ্রাম ছেড়ে চলে যেত।

শুনানি শেষে আদালত থেকে বেরিয়ে খন্দকার মাহবুব ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘অনেক চার্জে ওনার (নিজামীর) খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তার পরও কোনো চার্জে যদি আদালত সাজা দেন, তাহলে তাঁকে চরম দণ্ড দেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি না।’

‘অপরাধ স্বীকার করে শুধু মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে বাঁচতে চায় নিজামী’

খন্দকার মাহবুবের বক্তব্যের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আসামিপক্ষের আইনজীবীদের থেকে এ রকম স্পষ্ট বক্তব্যে দোষ স্বীকার করে নেওয়ার ব্যাপার আমি এই প্রথম দেখলাম। তাঁদের বক্তব্যের ভেতরে তাঁরা বলেছেন, হ্যাঁ, ঘটনাগুলো ঘটেছে। এরা এগুলোর ভেতর যুক্ত ছিল, এটা ঐহিতাসিক সত্য। তার পরও তারা এটা করেছে তাদের বিশ্বাস থেকে। তাই এখন যেহেতু ওনার (নিজামী) বয়স হয়ে গেছে ৭৩-৭৪ বছর, ওনার সাজা বাড়ানো-কমানো আদালতের ব্যাপার। তবে সাজা কমবে-এটা আমি বিশ্বাস করি না।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বক্তব্যের শেষ প্রান্তে ওনাদের শীর্ষ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন যেটা বলেছেন এটা তো ঐতিহাসিক ঘটনা যে খুন, মানুষ হত্যা-এগুলো হয়েছে এবং এগুলোতে সহযোগিতাও করেছে সে সময়ের জামায়াতে ইসলামী। মতিউর রহমান নিজামী তাঁর বিশ্বাস থেকেই এগুলোকে সমর্থন করেছেন।…শেষ মুহূর্তে উনি (খন্দকার মাহবুব) বলেছেন, এগুলো যদি তিনি (নিজামী) করেও থাকেন, তবু বয়সের কথা চিন্তা করে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়ার তিনি আবেদন করেছেন। কাগজপত্র যা দেখেছি, নথিপত্র যা দেখেছি-এটা সাজা কমানোর বিষয় না।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘পাকিস্তান আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যেসব কথা বলেছে এবং যেসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি করেছে, বিএনপি প্রতিবাদ না করলে তাদের রাজনৈতিকভাবে একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। তারা বুদ্ধিমানের কাজই করেছে। তারা ভেতর থেকে না বললেও অন্ততপক্ষে বাহ্যিকভাবে যে প্রতিবাদ করেছে, এটা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই করেছে।’

‘দোষ স্বীকারের প্রশ্নই আসে না’

অ্যাটর্নি জেনারেলের ব্রিফিংয়ের পর বিকেলে খন্দকার মাহবুব দোষ স্বীকার প্রশ্নে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? প্রশ্নই আসে না। তাহলে মামলা করলাম কেন?’ তিনি বলেন, ‘টিভিতে অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেবের বক্তব্য আমি যা শুনলাম তা ফৌজদারি আইন সম্পর্কে অজ্ঞতাপূর্ণ। অ্যাটর্নি জেনারেল যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অনভিপ্রেত।’ তিনি বলেন, ‘ফৌজদারি মামলায় বিকল্প দণ্ডের আবেদন করার সুযোগ সব সময় থাকে। তবে এর অর্থ এ নয় যে আইনজীবীরা দোষ স্বীকার করে মৃত্যুদণ্ড কমানোর আবেদন করেছেন। আমি বলেছি, অনেকগুলো অভিযোগের কোনোটিতে যদি মনে হয় অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, সেই ক্ষেত্রে আসামির বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনায় তিনি লঘুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য।’

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top