বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৬৫
আফগানিস্তান: ৫০ ওভারে ২৫৮
ফল: বাংলাদেশ ৭ রানে জয়ী
হার-জিতে বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ছিল সমানুপাতিক অবস্থায়-১: ১। তবু মিরপুরের কালকের ম্যাচে ফেবারিট ছিল বাংলাদেশই। ওয়ানডে থেকে ১০ মাসের বিরতিতেও মাশরাফি বিন মুর্তজার দলের ছবি থেকে বাঘের মুখটা হারিয়ে যেতে দেয়নি তাদের সর্বশেষ সাফল্য। ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে আসার পর ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টানা চার সিরিজ জয়। ঘরের মাঠে সেই দলের সামনে আফগানিস্তান আর কী চ্যালেঞ্জ জানাবে!বাংলাদেশ ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত ৭ রানে জিতলেও আফগানরা চ্যালেঞ্জ ঠিকই জানাল। উপহার দিল রুদ্ধশ্বাস এক ম্যাচ। ২৬৫ রান করেও ম্যাচের শেষ ওভার পর্যন্ত বাংলাদেশকে ভুগতে হয়েছে সংশয়ে। ৬ বলে আফগানিস্তানের দরকার ছিল ১৩ রান, হাতে ২ উইকেট। ওয়ানডেতে এমন জায়গা থেকে জেতার নজির ভূরি ভূরি। না, শেষ ওভারের জয় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশেরই। তাসকিন দুটি উইকেটই তুলে নিলেন, রান এল মাত্র ৫।
৪০ ওভার পর্যন্ত আফগানিস্তানের স্কোর ছিল ১৮৯/২। হাতে ৮ উইকেট রেখে ৬০ বলে ৭৭ রান তোলা এমন কিছু ছিল না। কিন্তু কাজটা কঠিন করে দিলেন সাকিব আল হাসান। এর আগে ওপেনার সাবির নূরিকে ফিরিয়ে বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি (২০৭) উইকেট নেওয়া আবদুর রাজ্জাকের রেকর্ড স্পর্শ করেছেন। ৪১তম ওভারের দ্বিতীয় বলে রহমত শাহকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলে রেকর্ডটা করে নিলেন একার। দেশের হয়ে তিন সংস্করণের ক্রিকেটেই সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক সাকিবই বিশ্ব ক্রিকেটে প্রথম।৪৬ রানে ২ উইকেট পড়ার পর হাসমতউল্লাহ শহীদি (৭২) আর রহমত (৭১) মিলেই আফগানদের দেখাচ্ছিলেন জয়ের স্বপ্ন। ১৪৪ রানের জুটি, তৃতীয় উইকেটে আফগানিস্তানের পক্ষে এখন এটাই সবচেয়ে বড় অংশীদারত্ব। সাকিব সেই জুটি ভেঙে দেওয়ার পরই জয়ের স্বপ্ন ফিকে হতে থাকে আফগানদের। ৪৪তম ওভারে তাইজুল ফেরান শহীদিকেও। তবে যুদ্ধবিগ্রহ দেখে অভ্যস্ত আফগান ক্রিকেটাররা কালকের ‘যুদ্ধ’টাকে নিয়ে গেছে শেষ ওভার পর্যন্ত। তাতে অবশ্য বাংলাদেশের ফিল্ডারদেরও ছিল ভালো ‘ভূমিকা।’ ইমরুল কায়েস, মাহমুদউল্লাহ, রুবেল হোসেনরা যেন নেমেছিলেন ক্যাচ ছাড়ার প্রতিযোগিতায়।ফিল্ডিং আফগানিস্তানেরও হয়েছে খুবই বাজে। তবু বাংলাদেশ ইনিংসের শেষ ১০ ওভারে ফিরে এসেছিল ২০১৫ বিশ্বকাপের স্মৃতি। ক্যানবেরায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৪০ ওভার শেষে ৪ উইকেটে ১৯৬ ছিল বাংলাদেশের স্কোর। কিন্তু শেষ ১০ ওভারে মাত্র ৭৩ রানে হারাতে হয় ৬ উইকেট। শেরেবাংলা স্টেডিয়ামেও কাল বাংলাদেশের ইনিংসের শেষটা হলো একই রকম। ৪০ ওভার শেষে স্কোর ৩ উইকেটে ১৯৬। শেষে কিনা অলআউট ২৬৫ রানে! শেষ ১০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ৬৯। বিশ্বকাপের ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও বাংলাদেশের শেষ উইকেট পড়েছে ইনিংসের শেষ বলে।
ক্যানবেরায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ জেতায় এই নেতিবাচক মিলে অমঙ্গল খুঁজতে হয়নি, যেটা শঙ্কা জাগিয়েছিল ইনিংসের প্রথম ওভারে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের সর্বশেষ দুটি ম্যাচে অপরাজিত ৮৮ আর ৯০ রানের ইনিংস ছিল সৌম্য সরকারের। কিন্তু ব্যাটের সেই সৌম্য-সৌন্দর্য সাম্প্রতিক সময়ে নিখোঁজ। ঘরোয়া ক্রিকেটে আলো কাড়েননি, অনুশীলনের ব্যাটিংয়েও ভুগেছেন অস্বস্তিতে। কাল ইনিংসের পঞ্চম বলে দৌলত জাদরানের বলে মিড উইকেটে সাবির নূরির হাতে ক্যাচ দিয়ে সৌম্য যেন সে ধারাবাহিকতাই ধরে রাখলেন।
তবে প্রথম ওভারে যে শঙ্কাটা জেগেছিল বলে বলা হচ্ছে, সেটা সৌম্যকে নিয়ে নয়; পুরো দলের ভবিষ্যৎ নিয়েই। ইনিংসের পঞ্চম বলে প্রথম উইকেটের পতন, স্কোরবোর্ডে ১/১ যে মনে করিয়ে দিচ্ছিল ২০১৪-এর এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের কাছে হেরে যাওয়া ম্যাচটাকেই! সেই ম্যাচেও দলের ১ রানের সময় প্রথম উইকেট হিসেবে বিদায় নিয়েছিলেন ওপেনার শামসুর রহমান এবং সেটাও ইনিংসের পঞ্চম বলেই।আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলা আগের দুই ম্যাচের সঙ্গে মিল এটুকুই। নইলে ঘটনার পারম্পর্য, কুশীলব সবই ভিন্ন। শুরুর ধাক্কার পর ইনিংসের চিত্র আস্তে আস্তে বদলে দেন তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ, সাকিব আল হাসান, ইমরুল কায়েসরা। ৩৬তম ওভার পর্যন্ত ‘নেতৃত্বে’ ছিলেন ওপেনার তামিমই। দ্বিতীয় উইকেটে ইমরুলের সঙ্গে ৮৩ ও তৃতীয় উইকেটে মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ৭৯ রানের জুটি। আফগানিস্তানের অভিষিক্ত পেসার নাভিন-উল-হকের হাতে লং অফে ক্যাচ দেওয়ার আগেই দলের রান ৩৫ ওভারে ১৬৩।৯৮ বলে খেলা ৮০ রানের ইনিংসেই দলের জন্য যা করার করে দিয়েছিলেন তামিম। ব্যক্তিগত ৩০ রানে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ দিয়েও হাসমতউল্লাহর পিচ্ছিল হাতের সৌজন্যে বেঁচে গেছেন। ওটা বাদ দিলে ব্যাট হাতে তামিম এতটাই স্বচ্ছন্দ ছিলেন যে, কেউ বলে না দিলে বোঝার উপায় ছিল না হাতের চোট কাটিয়ে মাত্র তিন-চার দিন ব্যাটিং প্র্যাকটিসেই নেমেছেন সিরিজ খেলতে।মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিংও ছিল দৃষ্টিসুখকর। ওয়ানডে থেকে প্রায় এক বছরের বিরতি তাঁর ব্যাটেও জং ধরাতে পারেনি প্রমাণ করল ৭৪ বলে ৬২ রানের স্ট্রোক ঝলমলে ইনিংস। পাঁচ বাউন্ডারির সঙ্গে মিরওয়াইস আশরাফ ও জাদরানের বলে দুই ছক্কা। এর বাইরে বাংলাদেশ ইনিংসেই আর কোনো ছক্কা নেই। তবে কাভারে মোহাম্মদ নবী ক্যাচ ফেলায় ৫৮ রানে একবার জীবন ফিরে পেয়েছেন তিনিও। শেষ ১০ ওভারের মড়কটা মূলত লাগে ৪১তম ওভারে মাহমুদউল্লাহর আউটের পর। সাকিবের সঙ্গে ৪০ রানের চতুর্থ উইকেট জুটি ভাঙার পর শেষ ৬ উইকেট পড়েছে ৬২ রানে। নিজে ৪৮ রান করলেও লড়াইয়ে সঙ্গী পাননি সাকিব।বাংলাদেশের জয়োত্সবে অবশ্য বাধা হয়নি কিছুই। বাজে ফিল্ডিং আর আগের দুটি ম্যাচের নেতিবাচক স্মৃতি শঙ্কা হয়ে দেখা দেওয়ার পরও শেষ হাসি বাংলাদেশের। শুধু আফগানিস্তানকেই নয়, রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনাকে জয় করে বাংলাদেশ যেন হারিয়ে দিল ১০ মাসের ওয়ানডে-অনভ্যস্ততাকেও!