বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ইসতিয়াক আহমেদ বুধবার নিজ কার্যালয়ে বসে যুগান্তরকে বলেন, আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির (আইওসি) কাছ থেকে বেশি দামে গ্যাস ক্রয় করা হচ্ছে। ওই গ্যাস আবার কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে ক্রয় ও বিক্রয় মূল্যের মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানের লোকসান হিসেবে বিবেচিত। ফলে আদায়কৃত অর্থ কোষাগারে জমা না দিয়ে লোকসান সমন্বয় করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এটি হয়েছে মূলত এনবিআরের একটি অস্পষ্ট প্রজ্ঞাপনের কারণে।জানা গেছে, আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি শেভরন, ক্রিস এনার্জি, কেয়ার্ন এনার্জিসহ চারটি কোম্পানি বাংলাদেশে গ্যাস উৎপাদনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় পেট্রোবাংলার সঙ্গে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মোট গ্যাস উৎপাদনের ৫৫ শতাংশের মালিক হচ্ছে আইওসি। উৎপাদনের অবশিষ্ট গ্যাসের ৪৫ শতাংশ গ্যাস চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা এবং উৎপাদিত প্রতিষ্ঠান আইওসির মধ্যে ৬৫ : ৩৫ অনুপাত হারে ভাগ হবে। অর্থাৎ উৎপাদিত গ্যাসের অবশিষ্ট ৪৫ শতাংশের মধ্যে ৬৫ ভাগ পাবে পেট্রোবাংলা এবং ৩৫ ভাগ পাবে আইওসি।উল্লেখিত শর্তে ১৯৯৮ সাল থেকে আইওসি গ্যাস উৎপাদনে যায়। আর শুরু থেকে আইওসির মোট উৎপাদিত গ্যাসের বিক্রি মূল্যের ওপর ৫৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় করে আসছে পেট্রোবাংলা। এ পর্যন্ত আইওসির কাছ থেকে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ ১৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। মূসক আইন অনুযায়ী এর ওপর দণ্ড সুদ বাবদ আরও নয় হাজার ৮০ কোটি টাকা আসে। অর্থাৎ মোট ২২ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা রাজস্ব দেয়ার কথা থাকলেও পেট্রোবাংলা এই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা করেনি। অবশ্য রাজস্ব ফাঁকির এই ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত এনবিআর উদঘাটন করে।এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান যুগান্তরকে জানান, পেট্রোবাংলার রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় মধ্যস্থতা করছে। তিনি আরও বলেন, পেট্রোবাংলার কিছু টাকা দেয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে কিছু টাকা দিয়ে তারা আবার বন্ধ করে দিয়েছে। এখন বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয় সুরাহা করবে।অর্থ আদায়ে কমিটির সুপারিশ : জানা গেছে, পেট্রোবাংলা থেকে এই অর্থ আদায়ের ব্যাপারে গত ৩ আগস্ট অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠক হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা, এনবিআরের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট সদস্য, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং পেট্রোবাংলার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে অর্থ আদায়ের ব্যাপারে তৎকালীন বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলামকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। জানা গেছে, কমিটি তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে পেট্রোবাংলা রাজস্ব বাবদ গ্রহণকৃত টাকা জমা দিয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা। এছাড়া পেট্রোবাংলা ও এর অধীন গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো শুরু থেকে এ পর্যন্ত আইওসির উৎপাদিত গ্যাস বিতরণের বিপরীতে রাজস্ব বাবদ কী পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে। আদায়কৃত অর্থের কী পরিমাণ অর্থ কোষাগারে জমা দিয়েছে। এসব বিষয়ে নিরীক্ষা করতে বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের কার্যালয় থেকে বিশেষ অডিট টিম নিয়োগের সুপারিশও করা হয়। এছাড়া বিপুল অংকের এই টাকা পরিশোধে পেট্রোবাংলাকে সুনির্দিষ্ট গাইড লাইন দ্রুত প্রণয়ন এবং একটি বাফার তহবিল গঠনেরও কথা বলা হয়। পাশাপাশি গ্যাস ক্রয় ও বিক্রয় মূল্যের পার্থক্য কমাতে সংশোধিত বাজেট থেকে ভর্তুকি প্রদানের যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখতে বলেছে সরকারকে।কমিটির মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়, পেট্রোবাংলা এই রাজস্ব জমা না দেয়ায় মোট রাজস্ব আয় এবং জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় অবমূল্যায়িত হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়, আইওসি থেকে পেট্রোবাংলা বেশি দামে গ্যাস ক্রয় করে গ্রাহকের কাছে কম দামে বিক্রি করছে। এ কারণে মূল্য ঘাটতি ফান্ড বাবদ মার্জিন অপ্রতুল রয়েছে। এর ফলে মূল্য ঘাটতি পূরণে পেট্রোবাংলা সরকারের সিদ্ধান্ত ছাড়াই আইওসির গ্যাসের অংশের মূসক ও সম্পূরক শুল্ক সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে রেখে দিয়েছে। এনবিআরের পক্ষ থেকে এর আগে কোনো আপত্তি না ওঠায় পেট্রোবাংলা গত ১৩ বছর ধরে নিজস্ব ব্যাখ্যা অনুযায়ী আইওসির রাজস্ব দিয়ে মূল্য ঘাটতি পূরণের চর্চা করে আসছে।
রাজস্ব জমা না দেয়ার পেছনে পেট্রোবাংলার ব্যাখ্যা : পেট্রোবাংলা থেকে এ বিষয়ে বলা হয়, প্রতি এক হাজার ঘনফুট গ্যাস আইওসি থেকে ২৮০ টাকা দরে কেনা হচ্ছে। ওই গ্যাস বিক্রি করা হচ্ছে ১৭৬ টাকায়। ঘাটতির ১০৪ টাকা হচ্ছে লোকসান। এছাড়া ১৭৬ টাকা বিক্রয় মূল্য থেকে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল, গ্যাস নিরাপত্তা তহবিল, গ্যাস বিতরণ কোম্পানি, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি এবং সরকারের এসডি ভ্যাট বাবদ ১৩০ টাকা চলে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃত অর্থে পেট্রোবাংলার কাছে থাকছে মাত্র ৪৬ টাকা। মোট লোকসানের হিসাবে ২৮০ টাকায় গ্যাস কিনে পেট্রোবাংলা পাচ্ছে ৪৬ টাকা। বাকি ২৩৪ টাকা হচ্ছে ঘাটতি।এ প্রসঙ্গে সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এই লোকসানের ঘাটতি মেটাতে গিয়ে সরকারের রাজস্ব দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আইওসি থেকে আদায় করা ১ হাজার ৭০১ কোটি টাকার রাজস্ব জমা দেয়া হয়েছে এনবিআরকে। কিন্তু এরপর আর দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ রাজস্বের টাকা দিতে গিয়ে আইওসির অর্থ পরিশোধ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।প্রজ্ঞাপনকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে রাজস্ব তছনছ : অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, সরকারের সঙ্গে কোনো বেসরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান চুক্তিবদ্ধ হয়ে গ্যাস উৎপাদন করলে তাদের উৎপাদিত গ্যাসের বিক্রয় মূল্য কর ও শুল্ক মওকুফ সুবিধা পাবে। ১৯৯৩ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এসআরও নং (২২৭-আইন/৯৩/৮৪ মুসক) মাধ্যমে এই সুবিধা প্রদান করেছে। প্রজ্ঞাপনে পরিষ্কার বলা হয়, শুধুমাত্র সরকারের সঙ্গে উৎপাদন অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে চুক্তিবদ্ধ কোনো বেসরকারি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও সরবরাহকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম অয়েল ও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক মওকুফ পাবে। সেখানে আরও বলা হয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বা কোনো বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন, উৎপাদন বা উৎপাদনে সরকারের অংশীদারিত্ব সম্পর্ক স্বাক্ষরিত চুক্তির ক্ষেত্রেও এই সুবিধা পাওয়া যাবে। প্রজ্ঞাপন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এখানে কোনো বিদেশী কোম্পানি এই সুবিধা পাবে তা উল্লেখ করা হয়নি। আবার পাবে না, তাও বলা হয়নি। এ অবস্থায় পেট্রোবাংলা নিজেরা ধরে নিয়েছে বিদেশী কোম্পানি আইওসি এই সুবিধা পাবে। তাই পেট্রোবাংলা আইওসি’র কাছ থেকে গ্যাসের মূল্য বাবদ টাকা নিলেও সেখানে এনবিআরের প্রাপ্য রাজস্বের বিষয়টি নিষ্পত্তি করেনি। এ কারণে রাজস্ব বাবদ এনবিআরের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি