সুনামগঞ্জে দিরাই উপজেলার কেজাউরা গ্রামে শিশু তুহিন খুনের নৃশংস ঘটনায় তার বাবা, তিন চাচা ও চাচতো ভাই জড়িত ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। গতকাল সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে আলোচিত এ খুনের ঘটনা সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান। তিনি জানান, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ঠাণ্ডা মাথায় বাবা-চাচারা মিলে খুন করে ৫ বছর বয়সী শিশু তুহিনকে। ঘুমন্ত শিশুটিকে বাবা আব্দুল বাছির কোলে করে বাড়ির বাইরে নিয়ে যান। বাবার কোলেই ঘুমন্ত অবস্থায় শিশু তুহিনকে ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে চাচা নাসির উদ্দিন। তিনি জানান, এ সময় নাছিরকে সহযোগিতা করেছিল শিশু তুহিনের চাচা মছব্বির, জমসের ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ার। পরে প্রতিপক্ষের নাম খোদাই করা দুটি ছুরি ঢুকিয়ে দেয় শিশু তুহিনের পেটে। এর আগে সুনামগঞ্জ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারা জবানবন্দিতে খুনের ঘটনায় সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে শিশু তুহিনের চাচা নাসির উদ্দিন ও চাচতো ভাই শাহরিয়ার।
ঘটনায় জড়িত বাবা আব্দুল বাছির, চাচা মছব্বির আলী ও জমসের আলীকে তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
এদিকে, ময়নাতদন্ত শেষে রাতেই তুহিনের মরদেহ দাফন করা হয়েছে গ্রামের বাড়িতে। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডে শোকে স্তব্ধ সুনামগঞ্জ জেলা। ছোট ওই শিশুকে হত্যার পর তার শরীরে নারকীয় অত্যাচারের ঘটনায় হতবিহ্বল বিবেকবান মানুষ। গতকাল সকাল থেকে সুনামগঞ্জ ও দিরাই উপজেলায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। এর আগে সোমবার রাতে দিরাই থানায় তুহিনের বাবা আবদুল বাছির, চাচা জমশেদ আলী, আব্দুল মোছাব্বির, নাসির, জাকির, চাচাতো ভাই শাহারুল, চাচাতো বোন তানিয়া, চাচী খায়রুন বেগম, প্রতিবেশী আজাদুরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে পরিবারের সদস্যরা সম্পৃক্ত জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছেন বলে জানান পুলিশ সদস্যরা।
গতকাল দুপুরে দিরাই থানা পুলিশের একটি বিশেষ টিম তুহিনের বাবা আবদুল বাছির, চাচা জমশেদ আলী, আবদুল মোছাব্বিরকে সুনামগঞ্জ আদালতে নিয়ে আসে। বিকাল সাড়ে ৪টায় ওই ৩ জনকে আদালতে তোলা হয়। দিরাই থানা পুলিশের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সন্দেহভাজন বাবা ও দুই চাচার ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালতের বিচারক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল খালিক।
ওদিকে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন তুহিনের মা। পরে দুপুর আড়াইটার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাবার বাড়ি একই ইউনিয়নের জকিনগর গ্রামে যান তিনি। এ সময় তুহিনের মাকে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলেও তিনি কিছু বলেননি। তুহিনের মামা নুরুজ্জামান জানান, তুহিনের মা অসুস্থ। হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তিনি পরে কথা বলবেন।
এ হত্যাকাণ্ডে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে সুনামগঞ্জ। জেলা শহর ও দিরাইয়ে পৃথক পৃথক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে সংগঠনগুলো। ‘খেলাঘর চায় না শিশুদের কান্না’ এই স্লোগানে শিশু তুহিন হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সুনামগঞ্জ ও দিরাইয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। সকালে খেলাঘর সুনামগঞ্জ জেলা শাখার আয়োজনে শহরের আলফাত স্কয়ারে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, খেলাঘর সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি বিজন সেন রায়, সাধারণ সম্পাদক এনাম আহমদ, রবিউল ইসলাম, সুজনের সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার, সাংগঠনিক সম্পাদক সোরাজু আহমেদ প্রমুখ।
তুহিনের মামলার আসামিদের পক্ষে আদালতে দাঁড়াবেন না দিরাই উপজেলার কোনো আইনজীবী। আইনজীবীরা তুহিনের পক্ষে বিনা খরচে আইনি সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সুনামগঞ্জস্থ দিরাই কল্যাণ সমিতি আয়োজিত এক মানববন্ধনে।
গতকাল দুপুর একটায় সুনামগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে দিরাই কল্যাণ সমিতির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট হুমায়ূন মঞ্জুর চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও অ্যাডভোকেট শহীদুল হাসমত খোকনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, অ্যাডভোকেট দিলীপ কুমার দাস, অধ্যক্ষ রবিউল ইসলাম, অ্যাডভোকেট জিয়াউর রহিম শাহীন, অ্যাডভোকেট আজাদুল ইসলাম রতন, অ্যাডভোকেট আবুল কাশেম, অ্যাডভোকেট কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট আব্দুল আহাদ, অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদ, অ্যাডভোকেট ওবায়দুর রশিদ চৌধুরী মিটু প্রমুখ।
উল্লেখ্য, ১৩ই অক্টোবর রাতে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে রাতে ঘর থেকে তুলে নিয়ে পাঁচ বছরের শিশু তুহিনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ঘাতকরা তার লাশ রাস্তার পাশের একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। এ সময় তুহিনের শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। তার পেটে দুটি ছুরি ঢোকানো ছিল, দুটি কান কাটা, এমনকি যৌনাঙ্গটিও কেটে ফেলা হয়।