আগামী অক্টোবর মাসেই হতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন। দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে সম্মেলনের ব্যাপারে তার সম্মতি দিয়েছেন। ফলে সম্মেলনকে ঘিরে দলের মধ্যে প্রাথমিক প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। তারই অংশ হিসেবে আট বিভাগের জন্য গঠিত আটটি কমিটি তাদের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবে রমজান, ঈদ এবং পঞ্চম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের পরপরই মেয়াদোত্তীর্ণ জেলাগুলোর সম্মেলন শেষ করা হবে।
এর আগে গত ২৯ মার্চ শুক্রবার অনুষ্ঠিত দলের সভাপতিমণ্ডলীর সভা থেকে চলতি বছর অক্টোবর মাসে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ওই মাসেই আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হবে। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৩ ও ২৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠকে ২১তম কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের পর তা বাস্তবায়নে বেশ তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। তার ধারাবাহিকতায় একাধিকবার সম্পাদকমণ্ডলীর সভা অনুষ্ঠিত হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের সভাপতিত্বে এসব সভায় জাতীয় সম্মেলন নিয়ে নানা আলোচনা হয়। সভা থেকে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবে জেলা সম্মেলন শেষ করার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। জেলা-উপজেলা সম্মেলনের পাশাপাশি দলের নিষ্ক্রিয় ও মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী সংগঠনের কমিটির ব্যাপারেও আলোচনা হয় বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা। এ ছাড়াও সাংগঠনিক সফর, সদস্য সংগ্রহ অভিযান সম্পন্ন করা ও দলীয় কোন্দল নিরসনের ওপর জোর দেয়া হয় বৈঠকে।
আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়–য়া নয়া দিগন্তকে জানান, আওয়ামী লীগের ৭৭টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে প্রায় বেশির ভাগেরই মেয়াদ উত্তীর্ণ। তাই জাতীয় কাউন্সিলের আগে এসব জেলার সম্মেলন শেষ করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
এদিকে অতীতের মতো আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনেও আগ্র্রহের কেন্দ্রবিন্দু সাধারণ সম্পাদক পদ। কাকতালীয় কিছু না ঘটলে শেখ হাসিনাই সভাপতি থাকছেন সেটা একরকম নিশ্চিত। তবে তার রানিংমেট কে হচ্ছেন সেটি নিয়ে নেতাকর্মীদের আগ্রহের শেষ নেই। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অসুস্থ হওয়ায় এ পদে কে আসছেন তা নিয়ে নানা জল্পনা চলছে।
দলের দফতর সূত্র অনুযায়ী, মুসলিম লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ গঠিত হলেও দলটির প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে।
৭০ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় এ পর্যন্ত দলটির ২০টি সম্মেলন হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদায়ী আওয়ামী লীগে চারবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দীন আহমদ, জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দুই বা এর বেশিবারের জন্য সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। দলটির ইতিহাসে আবদুল জলিল একবারের জন্য সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর ২০তম সম্মেলন হয় আওয়ামী লীগের। ওই সম্মেলনে ৮১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়, যার সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গত ৩ মার্চ থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও চিকিৎসকদের ফলোআপে থাকতে হচ্ছে তাকে। এ মাসেই তার দেশে ফেরার কথা। তবে বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের কারণে দেশে ফিরলেও ৬৭ বছর বয়সী ওবায়দুল কাদের এ মুহূর্তে দল ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পুরোদমে নিতে পারবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বলা হচ্ছে, তার পুরোপুরি সেরে উঠতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা মনে করছেন, ভালোভাবে সুস্থ হয়ে ওঠার জন্যই ওবায়দুল কাদেরের বিশ্রামে থাকা প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এমন পরিস্থিতিতে আগামী তিন বছরে আওয়ামী লীগের বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের পরিকল্পনা সুসম্পন্ন করার জন্য সভাপতির আস্থাভাজন, ডায়নামিক ও নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন সাধারণ সম্পাদক প্রয়োজন। সেই আলোচনায় প্রথমেই আসছে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল উল আলম হানিফের নাম। ইতোমধ্যেই তিনি সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছেন। এর আগেও একাধিকবার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। নেতাকর্মীদের কাছেও যথেষ্ট কদর রয়েছে তার। তিনি শেখ পরিবারেরও আত্মীয়।
এরপরই আলোচনায় রয়েছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শে তিনি বিভিন্ন সময় দলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবীর নানক এবং আবদুর রহমানকে নিয়েও নানা জল্পনা চলছে। জাহাঙ্গীর কবীর নানক, আবদুর রহমানকে এবারের সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়নি। তবে তাদেরকে নির্বাচনী পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব দেয়া হয়।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, দল ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য রাখতে চান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বারবার তিনি নতুন নেতৃত্বের কথা বলেছেন। দলকে শক্তিশালী করা, তৃণমূলে আওয়ামী লীগকে আরো বিস্তৃত করা, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের জন্য গতিশীল সংগঠন গড়ে তুলতে চান তিনি। দেশের তরুণদের সম্পৃক্ত করে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার জন্যও সময়ের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে সক্ষম এমন নেতৃত্বের হাতেই তুলে দিতে চান দলের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে ২১তম জাতীয় সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে চমক থাকবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব:) ফারুক খান বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতিটি সম্মেলনেই গড়ে ৩০ ভাগ নতুন মুখ আসছে। জাতীয় সম্মেলনেও নেতৃত্বে অনেক নতুন মুখ আসবে। ভবিষ্যৎ দলের কথা বিবেচনা করেই তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান দেয়া হবে।
দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ নয়া দিগন্তকে বলেন, আগামী অক্টোবরে দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। দলীয় সভাপতির নির্দেশে সম্মেলনের সার্বিক প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। এরপর মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা কমিটিগুলোর সম্মেলনের কাজ শুরু হবে। সম্মেলনে কাউন্সিলররা প্রথমে সভাপতি নির্বাচন করবেন। এরপর তার ওপরই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের জন্য দায়িত্ব দেয়া হবে। আর দলীয় সভাপতি দলের স্বার্থে যোগ্য একজনকেই সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেছে নেবেন। সভাপতির ওপর দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সেই আস্থা আছে। নেতাকর্মীরা তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।