একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আজ রবিবার সকাল আটটা থেকে সারা দেশে ভোটের উৎসব শুরু হয়েছে। কোন রাজনৈতিক দল বা জোট সরকার গঠন করবে তা নির্ধারিত হবে আজ।
আজ ৩০ ডিসেম্বর, রবিবার সকাল থেকেই ভোটারদের বিভিন্ন কেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলবে দেশের ২৯৯টি আসনের প্রায় ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ। দেশের মোট ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন ভোটারের মধ্যে আজ ভোট দিতে পারবেন ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৬ হাজার ৭৩৫ জন ভোটার।
এবার দেশের নারী ভোটার পাঁচ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২ এবং পুরুষ ভোটার পাঁচ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৩৫ জন। রংপুর এবং রাজশাহী বিভাগে নারী ভোটার পুরুষের তুলনায় বেশি। রংপুর বিভাগের ৩৩ আসনের একটি, গাইবান্ধা-৩ আসনে একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে ভোটগ্রহণ হবে ২৭ জানুয়ারি। এ আসনে মোট ভোটার চার লাখ ১১ হাজার ৯৪২ জন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা গতকাল শনিবার বিকেলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ভোটের প্রতিযোগিতা যেন সহিংসতায় পরিণত না হয়। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে এজেন্টের পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে।
এজেন্টকে হয়রানি কোনোভাবেই কাম্য নয়। ভোটারদের প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, ‘আপনাদের ভোট অতি মূল্যবান। কোনো রকম প্রলোভন প্ররোচণা প্রভাব বা ভয়ভীতির কাছে নতি স্বীকার করবেন না। স্বাধীনভাবে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিন। ’ গত শুক্রবার তিনি বলেন, ‘নির্বাচন অবশ্যই উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে। আমরা প্রস্তুত, ভোটাররা সবাই উৎসবমুখর এবং আনন্দঘন পরিবেশে ভোটে অংশগ্রহণ করবে, কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকবে না। ’এবারের নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য : নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের মতে, এবারের নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে সর্বদলীয় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। দেশের নিবন্ধিত ৩৯টি দল এবং অনিবন্ধিত কয়েকটি দলের প্রার্থীরাও জোটভুক্ত নিবন্ধিত দলগুলোর প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। সেই সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও রয়েছেন। এ নির্বাচনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের পর এই প্রথম দলীয় সরকারের অধীনে দেশের সব রাজনৈতিক দল অংশ নিতে যাচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে এবারই প্রথম অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। সবার অপেক্ষা অংশগ্রহণমূলক এ নির্বাচন কতটা অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হয়। নির্বাচন কমিশন থেকে শুক্রবার জানানো তথ্য অনুযায়ী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৬১ জনে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর সংখ্যা এক হাজার ৭৩৩ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থী ১২৮ জন।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনগুলোর মধ্যে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ১৪টি রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ওই নির্বাচনে ১২০ জন নির্দলীয়সহ এক হাজার ৭৮ জন প্রার্থী ছিলেন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে ২৯টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। প্রার্থী ছিলেন ৪২২ জন নির্দলীয়সহ দুই হাজার ১২৩ জন। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সাধারণ নির্বাচন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট বয়কট করে। অংশ নেয় ২৮টি রাজনৈতিক দল। প্রার্থী ছিলেন ৪৫৩ স্বতন্ত্রসহ এক হাজার ১২৪ জন। এরপর ১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোট ও বিএনপির খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট বর্জন করে। ওই নির্বাচনে ৯টি দল অংশ নেয়। প্রার্থী ছিলেন ২১৪ জন স্বতন্ত্রসহ মোট ৯১৯ জন।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাধারণ নির্বাচন ছিল দেশের অন্যতম একটি ব্যর্থ নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিএনপি ও ফ্রিডম পার্টিসহ আরো নামসর্বস্ব ৪২টি দল অংশ নেয়। আওয়ামী লীগসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল বর্জন করে। স্বতন্ত্রসহ মোট এক হাজার ৪৫০ জন প্রার্থী এ নির্বাচনে অংশ নেন।
এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দলীয় সরাকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দশম সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে অথবা নির্বাচনী মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি দলের মধ্যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটসহ ২৮ দল। এ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ১০৪ জন স্বতন্ত্র এবং ১২টি দলের ৫৪৩ জন প্রার্থীর মধ্যে।
এ ছাড়া আজকের নির্বাচনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এবারই ছয়টি আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোটগ্রহণ। ইভিএমে যে ছয়টি আসনে ভোট হচ্ছে সেগুলো হচ্ছে রংপুর-৩, খুলনা-২, সাতক্ষীরা-২, ঢাকা-৬ ও ১৩ এবং চট্টগ্রাম-৯। আসনগুলোর ৮৪৫ ভোটকেন্দ্রের পাঁচ হাজার ৩৮টি ভোট কক্ষে এই মেশিনে ভোটগ্রহণ হবে। এসব আসনের মোট ভোটার ২১ লাখ ২৪ হাজার ৫৫৪ জন।
এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই : নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের তথ্য অনুসারে, অতীতে দলীয় সরকারের অধীনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ ছিল না, এমন সব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের অনেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেও এবার তা হচ্ছে না। ১৯৭৩ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ১১ জন, ১৯৮৮ সালে চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনে ১৮ জন, ১৯৯৬ সালে ৪৯ জন এবং ২০১৪ সালের দশম সাধারণ নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তাঁরা সবাই ক্ষমতাসীন দল বা জোটের প্রার্থী ছিলেন। এ ছাড়া একজন প্রার্থীর একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও এবার আগের যেকোনো নির্বাচনের তুলনায় অনেক কম।
কোন দলের কত প্রার্থী : নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের তথ্য অনুসারে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২৬০ আসনে। বিএনপির প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন ২৫৭ আসনে। সবচেয়ে বেশি ২৯৮ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরা। অন্য দলগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টি ১৭৫, এলডিপি আট আসনে (চার আসনে ধানের শীষ প্রতীকে), জাতীয় পার্টি-জেপি ১১, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল (এমএল) দুই, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ আট (তিন আসনে ধানের শীষে), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ৭৪, গণতন্ত্রী পার্টি ছয়, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ৯, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি আট (পাঁচ আসনে নৌকা প্রতীকে), বিকল্পধারা বাংলাদেশ ২৬ (তিন আসনে নৌকা প্রতীকে), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ ১১ (তিন আসনে নৌকা প্রতীকে), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি ১৯, (চার আসনে ধানের শীষে), জাকের পার্টি ৯০, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ ৪৪, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি তিন (এক আসনে ধানের শীষে), তরীকত ফেডারেশন ১৭ (এক আসনে নৌকা প্রতীকে), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ২৪, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৪৮, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ৭৯, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ আট (তিন আসনে ধানের শীষে), গণফোরাম ২৮ (সাত আসনে ধানের শীষে), গণফ্রন্ট ১৩, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল ১৪, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ তিন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ১১, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ১৮, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি দুই (এক আসনে ধানের শীষ), ইসলামী ঐক্যজোট ২৫, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস পাঁচ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ২৫, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি চার, বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ২৮, খেলাফত মজলিস ১২ (দুই আসনে ধানের শীষে), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল এক, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট দুই এবং বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ ৫৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে।
ভোটের নিরাপত্তা : এবারের নির্বাচনের নিরাপত্তার জন্য সশস্ত্র বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় সাত লাখ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচন পরিচালনায় মোট ছয় লাখ ৬২ হাজার ৭১৩ জন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। এ নির্বাচনে আচরণবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করার জন্য ৬৫২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের জন্য ৬৭৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, নির্বাচনী অপরাধের সংক্ষিপ্ত বিচারকাজ পরিচালনার জন্য ৬৪০ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ১২২টি নির্বাচনী তদন্ত কমিটিতে ২৪৪ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে রয়েছেন।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরের সাধারণ কেন্দ্রে ১৪ থেকে ১৫ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৬ জন সদস্য মোতায়েন থাকবে। মেট্রোপলিটন এলাকার কেন্দ্রগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ওই সংখ্যা থেকে একজন করে বেশি রাখা হবে। পার্বত্য এলাকা, দ্বীপাঞ্চল, হাওর এলাকার কেন্দ্রগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসংখ্যা আরো বেশি থাকবে।