ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান ২০০০ সালে ৫০ লাখ টাকায় একটি অকৃষি জমি কেনেন। সরকার নির্ধারিত মৌজার দাম অনুযায়ী হিসাব কষে তিনি ওই করবর্ষে আয়কর রিটার্নে এই জমির দাম উল্লেখ করেন ২৩ লাখ টাকা। গত আট বছরে এই জমির দাম বেড়ে প্রায় দুই কোটি টাকা হলেও আগের মতোই হাফিজুর রহমান এবারও সম্পদের বিবরণীতে জমির মূল্য উল্লেখ করেছেন ২৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে সম্প্রতি তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর যৌথ নামে পরিচালিত ব্যবসায় এ জমির বাজারদর চার কোটি টাকা দেখিয়ে বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে এক কোটি ২৫ লাখ টাকার ঋণ নিয়েছেন। ব্যাংকের হিসাবে হাফিজুর রহমান কোটিপতির তালিকায় থাকলেও আইনের ফাঁক গলিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) জমা দেওয়া রিটার্নের তথ্যানুসারে তিনি কোটিপতি নন।
আবার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মুস্তফা জামাল এক কোটি ৩৪ লাখ টাকার একটি বিলাসবহুল গাড়ি ৪৫ লাখ টাকায় এনে ভুয়া কাগজপত্রে বাংলাদেশ রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) থেকে নিবন্ধন নিয়ে দিব্যি চালাচ্ছেন। রিটার্নে তিনি গাড়িটি থাকার কথা উল্লেখ করেননি। একইভাবে আরো অনেক সম্পদের তথ্যও তিনি গোপন করেছেন। রিটার্নের তথ্যে মুস্তফা জামাল কোটিপতি না হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি কোটিপতি।
এনবিআর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অসাধু ব্যক্তিরা মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় আইনের ফাঁকে রিটার্নে বাজারদর অনুযায়ী (প্রপার্টি ইভ্যালুয়েশন) সম্পদের মূল্যায়ন না হওয়ায় সম্পশালীদের প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। একই মত জানিয়ে অর্থনীতি বিশ্লেষকরা সম্পদশালীদের খুঁজে পেতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনলাইনে তথ্যের আদান-প্রদান করাসহ নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন।
এনবিআর সদস্য কালিপদ হালদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী রিটার্নে সম্পদের মূল্য উল্লেখ করা হয় না। এতে ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তথ্যের সঙ্গে রিটার্নের তথ্যের পার্থক্য থাকছে। এ সুযোগ নিয়ে অনেকে রিটার্নে প্রকৃত তথ্য দিচ্ছেন না। এ ছাড়া কিছু অসাধু ব্যক্তি রাজস্ব ফাঁকি দিতে প্রকৃত তথ্য গোপন করে মিথ্যা হিসাব দিয়ে সম্পদের পরিমাণ গোপন করছেন। রাজস্ব ফাঁকিবাজদের চিহ্নিত করতে এনবিআরের বিভিন্ন কর সার্কেল থেকে রিটার্নের তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যেসব রিটার্নের তথ্যে বড় ধরনের গরমিল পাওয়া যাচ্ছে তা এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা থেকে তদন্ত করা হচ্ছে।’
১৬ কোটি ২০ লাখ মানুষের বাংলাদেশে চলতি করবর্ষে নিয়মিত রিটার্ন জমার শেষ সময় গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ২০ লাখ ছয় হাজার ৭১৫ জন রিটার্ন জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে দুই কোটি টাকা বা এর বেশি সম্পদের মালিকের সংখ্যা ১৪ হাজারের কিছু বেশি। যুক্তিসংগত কারণ দেখিয়ে এনবিআরের অনুমতি নিয়ে ২ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে অর্থবছরের শেষ সময় পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন দাখিলের সুযোগ রয়েছে। অতীতের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে দেশে কোটিপতির সংখ্যা গড়ে দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৫০০ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে এনবিআর সূত্র জানায়।
সূত্র আরো জানায়, অতীতের ধারাবাহিকতায় চলতি করবর্ষে গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত জমা দেওয়া তথ্যে দুই কোটি টাকা ও এর বেশি সম্পদশালীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকায় আর সবচেয়ে কম রংপুরে। ঢাকার পরে রয়েছে চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহের অবস্থান। গত করবর্ষের মতো এবারও দুই কোটি টাকা ও এর বেশি সম্পদশালীর সংখ্যা আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশি। এরপর রয়েছেন তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। রাজধানীতে দুই কোটি টাকা ও এর বেশি সম্পদের মালিক সবচেয়ে বেশি ধানমণ্ডি, জিগাতলা, কলাবাগান ও পান্থপথে।
এনবিআর সূত্র জানায়, গত কয়েক করবর্ষে দুই কোটি টাকা ও এর বেশি সম্পদশালীর গড় সংখ্যা প্রায় একই হলেও এবার বেড়েছে। ২০১১ সালের সম্পদ বিবরণী অনুযায়ী দুই কোটি টাকা ও এর বেশি সম্পদ আছে—এমন করদাতার সংখ্যা ছিল চার হাজার ৩০৩। ২০১২ সালে চার হাজার ৮৬৫ জন, ২০১৩ সালে পাঁচ হাজার ১৪৫ জন, ২০১৪ সালে পাঁচ হাজার ৩২৯ জন, ২০১৫ সালে ছয় হাজার ৭৬১ জন। গত করবর্ষে দুই কোটি টাকা ও এর বেশি সম্পদের মালিক সবচেয়ে বেশি ঢাকায় আর সবচেয়ে কম রংপুর বিভাগে। ওই করবর্ষে চট্টগ্রামে এক হাজার ৭৪৮ জন, খুলনায় ৩০৬ জন, রাজশাহীতে ৯০ জন, বরিশালে ৮৬ জন, সিলেটে ২৩৪ জন, কুমিল্লায় ২৫৫ জন, ময়মনসিংহে ৭০ জন, রংপুরে ৬৭ জন। বাকিরা রাজধানীতে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিআরটিএ, আবাসন খাতের সংগঠন রিহ্যাব থেকে পাওয়া সম্পদশালীদের হিসাব থেকে এনবিআরের এ হিসাব কম।
দেশের ব্যাংকগুলোতে এক বছরের ব্যবধানে কোটি টাকার বেশি আমানত জমা রাখা ব্যাংক হিসাব বেড়েছে চার হাজার ৫১২টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার ওপরে আমানত জমা রয়েছে—এমন ব্যাংক হিসাব ৭০ হাজার ৪৬৩টি। গত বছরের মার্চে এ ধরনের হিসাবসংখ্যা ছিল ৬৫ হাজার ৯৫১।
পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত ৫০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যাংক হিসাব ৯৪১টি। ২০১৭ সালের একই সময়ে এ ধরনের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ৭৮৪টি। এ ছাড়া ৪০ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত রাখা ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ৩৬০। ৩৫ কোটি থেকে ৪০ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত জমা থাকা ব্যাংক হিসাব ছিল ২০৬টি। ৩০ কোটি থেকে ৩৫ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত রাখা ব্যাংক হিসাব ছিল ২৮৪টি। ২৫ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যাংক হিসাব ৫১০টি। ২০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যাংক হিসাব ৮২০টি। ১৫ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা এক হাজার ৩১৯টি। ১০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যাংক হিসাব দুই হাজার ৯২৬টি। পাঁচ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যাংক হিসাব আট হাজার ১২৭টি।
পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, এক কোটি টাকা আমানত রাখা ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ৫৪ হাজার ৯৭০টি। ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ৫২ হাজার ৮৭।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৯২ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে চার লাখ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ আমানত ছিল কোটিপতি ব্যাংক হিসাবগুলোতে।
বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী দেশে মার্সিডিস বেঞ্জ, বিএমডাব্লিউ, লেক্সাসের মতো বিলাসবহুল গাড়ি আছে ৫১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে মার্সিডিস বেঞ্জ গাড়িই আছে প্রায় ২৭ হাজার। বারভিডার তথ্যানুসারে, আমদানি শুল্কসহ এসব প্রতিটি গাড়ির বাজারদর এক-দেড় কোটি টাকা থেকে আট-দশ কোটি টাকা।
বারভিডার সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিলাসবহুল গাড়ি কিনে অনেকেই ব্যবহার করছে, অথচ শুল্ককর হিসেবে একটি টাকাও সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছে না। রিটার্নেও উল্লেখ করছে না। বৈধভাবে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করেও তার তথ্য আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করছে না। উন্নত দেশের মতো এনবিআর কর্মকর্তাদের অনলাইনে বিআরটিএর তথ্য ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। এতে তথ্য গোপনের সুযোগ থাকবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমণ্ডি, উত্তরা, বসুন্ধরা, সেগুনবাগিচায় বেশির ভাগ ফ্ল্যাট প্রতি বর্গফুট বিক্রি হয় ১০ হাজার টাকা থেকে ২০/২২ হাজার টাকায়। এর বাইরে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট এলাকায় বেশির ভাগ ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুট বিক্রি হচ্ছে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা থেকে আট-দশ হাজার টাকায়। এ হিসাবে মাঝারি আকারের এক হাজার ৫০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের বাজারমূল্য অভিজাত এলাকায় আসে এক-দেড় কোটি টাকা থেকে আড়াই-তিন কোটি টাকা। রিহ্যাবের তথ্যানুসারে, বেসরকারি খাতের তৈরি প্রায় দেড় লাখ থেকে দুই লাখ ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। ২০১৩ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাড়ির মালিকদের ওপর এনবিআরের পরিচালিত জরিপের তথ্যানুসারে, এ দুই শহরে এক লাখ চার হাজার বাড়ির মালিক কর দেয় না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজস্ব ফাঁকিবাজ অসাধু ব্যক্তিরা দিনের পর দিন সরকারকে ঠকাচ্ছে।’
ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, ‘আমাদের সমাজে সম্পদের মালিকদের বেশির ভাগই প্রভাবশালী। এই ব্যক্তিদের অনেকে আবার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন সময়ে এনবিআরের তদন্তে জনপ্রতিনিধিদের রাজস্ব ফাঁকির কথা জানা যায়। এনবিআরের সক্ষমতা বাড়িয়ে রাজস্ব ফাঁকিবাজ সমাজের শত্রুদের চিহ্নিত করতে হবে। আশার কথা হলো, এনবিআর আগের চেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে।’
সম্পদশালী রাজস্ব ফাঁকিবাজদের খুঁজে পেতে এনবিআর কী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে—এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এনবিআরকে প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেবে পড়ে তুলতে গুরুত্ব দিয়েছি। অনলাইনে ই-টিআইএন গ্রহণ, আয়কর রিটার্ন দাখিল, ই-ফাইলিং, অটোমেশনের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত কার্যক্রম, ভ্যাট বা মূসক আদায়সহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। এর মূল উদ্দেশ্য রাজস্ব ফাঁকি বন্ধ করা। অচিরেই অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনলাইনে তথ্য আদান-প্রদান হবে। ফলে সম্পদশালীরা প্রকৃত হিসাব দিতে বাধ্য হবে।’