রাতে অফিস থেকে বেরিয়ে বিমানবন্দর মোড়ে এসে দাঁড়াই। এর পরপরই ‘আসমানী’ নামের একটি বাস এসে সামনে দাঁড়ায়। বাসটি খিলক্ষেতে যাবে কি না প্রশ্ন করতেই গেটে দাঁড়ানো এক ব্যক্তি পিঠে হাত দিয়ে আমাকে গাড়িতে তুলে নেয়। অথচ আসমানী পরিবহনের বাস চলাচল রাত ১০টার মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। এত রাতে এই পরিবহনের বাস রাস্তায় কেন—জিজ্ঞাসা করতেই বাসের দরজা লাগিয়ে দেয় ওরা। এরপর বাসে থাকা কয়েকজন গামছা দিয়ে আমার চোখ বেঁধে ফেলে গলায় ছুরি ধরে বলে, বেশি কথা বলবি না। এমন কাউকে ফোন কর যে তিন লাখ টাকা দিতে পারবে। না দিলে তোকে মেরে নদীতে ফেলে দেব। এরপর ছোট ভাই তানভীরকে ফোন করে টাকা চাই। রাত ৩টা পর্যন্ত আধঘণ্টা পর পর আমাকে দিয়ে ফোন করে টাকা চাওয়া হয়। দিতে দেরি করায় মারধর করা হয়। এমনকি হাত-পা ও চোখ বেঁধে সিটের নিচে ফেলে রাখা হয় আমাকে।’
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে গতকাল রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে বেসরকারি কম্পানিতে কর্মরত তরিকুল ইসলাম কথাগুলো বলেন। গত ১৭ নভেম্বর রাতে বিমানবন্দর সড়ক থেকে অপহৃত হওয়া এই ব্যক্তি সেই ভয়ংকর ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। তরিকুল জানান, সারা রাত ঘোরাঘুরি শেষে পরদিন চারটি মোবাইল সিমের মাধ্যমে ৬৫ হাজার টাকা বিকাশ করা হয় ওদের দেওয়া নম্বরে। অবশেষে ১৮ নভেম্বর রাত ৮টার দিকে নরসিংদীর শিবপুরে একটি ব্রিজের নিচে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাঁকে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা।
এদিকে অপহরণের শিকার তরিকুলের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে ওই ঘটনায় জড়িতদের ধরতে অভিযান চালায় র্যাব-১। অবশেষে গত শনিবার রাত ১১টা থেকে ভোরের মধ্যে তুরাগ থানার কামারপাড়া এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে অপহরণের কাজে ব্যবহৃত দুটি বাস জব্দ করা হয় বলে দাবি করেছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের ইমরান, নাটোরের নলডাঙ্গার জিহাদ আলী ও জুলহাস হোসেন, ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের শান্ত হোসেন, ঢাকার আশুলিয়ার রকিবুল হাসান ও হাবীবুর রহমান, গাজীপুরের কাশিমপুরের রাকিবুল ইসলাম, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার নাঈম মিয়া এবং ময়মনসিংহ সদরের বাবুল হোসেন। তাদের সবার বয়স ১৯ থেকে ২২ বছরের মধ্যে।
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, অপহরণকারীদের এই দলে ৩০ থেকে ৩৫ জনের মতো সদস্য রয়েছে। রাত ৮টার পর ওরা রাস্তায় নেমে আসে। বড় কোনো স্টপেজ থেকে সাধারণত যাত্রী তোলে না। একজন বা দুজন যাত্রীকে বাসে তুলেই ওরা দরজা বন্ধ করে দেয়। এই চক্রে ইমরান, শান্ত, রাকিবুল ও জিহাদ হচ্ছে মাস্টারমাইন্ড। এরা প্রত্যেকেই এর আগে একটি ডাকাতি মামলায় ২২ মাস করে জেল খেটেছে। দিনের বেলায় এদের কেউ অটোরিকশা চালায়, কেউ বাসের হেলপার, কেউবা লেগুনা চালায়। রাতের বেলা এরা সার্ভিসিং সেন্টারে দেওয়া বাসগুলো ভাড়া নিয়ে অপহরণের কাজে নামে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, বাসের মালিক জানেনই না যে তার বাস দিয়ে অপরাধীরা অপহরণের মতো ভয়াবহ কাজ করছে।
র্যাব জানায়, অপহরণকারী এই চক্রটি গত ১৫ নভেম্বর গাবতলী টু চন্দ্রা রোডে চলাচলকারী জনসেবা পরিবহনের একটি মিনিবাস ড্রাইভারকে হাত-পা বেঁধে রেখে বাস নিয়ে শ্রীপুরের মাওনা এলাকায় চলে যায়। পরে বাসের মালিক ৩০ হাজার টাকা দিয়ে বাসটি নিয়ে আসেন। বাসটির মালিক ইয়ার হোসেনও গতকাল র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে উপস্থিত থেকে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।