Friday , 1 November 2024
সংবাদ শিরোনাম

ক্ষতিকর গরু চেনা জরুরি

এবার ঈদে কোরবানির জন্য সরকারি হিসাবে দেশি গরুই প্রস্তুত আছে প্রায় ৪৫ লাখ। সেই সঙ্গে আছে ভারতীয় ও নেপালি গরুর সমারোহ। ঈদুল আজহা সামনে রেখে বরাবরই স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করে দ্রুত মোটাতাজা করা হয় গরু। নাদুসনুদুস ধরনের ওই সব গরু কোরবানির পশুর হাটে সাজিয়ে রাখা হয় বিশেষ যত্নের সঙ্গে, যাতে দাম পাওয়া যায় চড়া। কোরবানির পশুর হাটে এমন অনিরাপদ বা বিষাক্ত প্রক্রিয়ায় মোটাতাজা করা গরুর বিষয়ে এরই মধ্যে সরকারের তরফ থেকে সর্বসাধারণকে সতর্ক করতে প্রচার শুরু করা হয়েছে। মাঠে নামানো হয়েছে মেডিক্যাল টিম।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক গোলাম কিবরিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোরবানির গরুতে স্টেরয়েডের ব্যবহার ঠেকাতে এরই মধ্যে আমরা সারা দেশে সতর্কতামূলক চিঠি দিয়েছি। আমাদের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে কঠোর নজরদারির নির্দেশনা দিয়েছি। অবৈধভাবে যাতে কোথাও ওই ওষুধ বেচাকেনা না হয় সেদিকেও নজর রাখছে আমাদের লোকজন।’

এর মধ্যেই গত কয়েক দিনে বিভিন্ন এলাকায় গরুর হাটে কিংবা হাটে সরবরাহের পথে বেশ কিছু গরু মারা যাওয়ার খবর প্রকাশ পেয়েছে। কেউ কেউ এসব গরুর মৃত্যুর কারণ হিসেবে গরমের কথা বললেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিকর স্টেরয়েড প্রয়োগ করার ফলে হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ও লিভার অকার্যকর হয়ে যখন তখন গরুর মৃত্যু হয়ে থাকে। প্রতিবছরই প্রায় সব গরুর হাটে এমনভাবে অনেক গরুর মৃত্যু হয়। আবার ক্রেতারা কোরবানির জন্য হাট থেকে গরু কিনে বাসায় নেওয়ার পরও গরুর মৃত্যু হওয়ার খবর পাওয়া যায়।

শুধু স্টেরয়েডই নয়, টিটেনাস জাতীয় ওষুধও গরু মোটাতাজাকরণের কাজে ব্যবহার করার নমুনা পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টেরয়েড ছাড়াও অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে গরুর মাংস মানুষের শরীরের জন্য বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে। আগুনের তাপে এসব স্টেরয়েড বা অ্যান্টিবায়োটিক নষ্ট হয় না। ফলে ওই সব ওষুধ দিয়ে মোটা করা গরুর মাংস খেলে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করে সেই ক্ষতিকর ওষুধ।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি নকল ও ভেজাল ওষুধবিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে অবৈধভাবে গরু মোটাতাজাকরণের জন্য ক্ষতিকর ওষুধের মজুদ পেয়েছি। এ ছাড়া মাত্র দুই দিন আগেই নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জনবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ কমর কোরবানির গরুর ক্ষেত্রে মানুষকে সতর্ক করেছেন স্টেরয়েড ও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যাপারে।’

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সায়েন্সেস অনুষদের ফিজিওলজি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রকিবুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ডোজ অমান্য করে অতিরিক্ত স্টেরয়েড ব্যবহারের মাধ্যমে গরু দ্রুত মোটাতাজা করতে গিয়ে গরুর লিভার, কিডনি ও হার্টের মারাত্মক ক্ষতি হয়। শরীর ফুলে গিয়ে মাংসের কোষের ফাঁকে ফাঁকে বিষাক্ত উপাদান জমে। গরুর অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। আবার জীবিত গরু কোরবানি হলেও তার মাংসের মাধ্যমে ওই স্টেরয়েড মানুষের শরীরে ঢুকে যায়। তিনি বলেন, যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে অসাধুচক্র প্রতিবছর কোরবানি ঘিরে স্টেরয়েড দিয়ে গরু দ্রুত মোটা করার তৎপরতায় লিপ্ত হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহামুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, যেকোনো স্টেরয়েড সুস্থ মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনে। এটা মানুষের কিডনি, লিভার, শ্বাসতন্ত্র, হৃদযন্ত্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। মানুষের ক্যান্সারসহ আরো কিছু রোগের চিকিৎসার জন্য কিছু স্টেরয়েড ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকলেও তা সুস্থ মানুষের জন্য একেবারেই নিষিদ্ধ। এ ছাড়া ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর পরিমিত মান-মাত্রা সংরক্ষিত হয়ে থাকে। কিন্তু গবাদি পশুর দেহে যে মান ও মাত্রার স্টেরয়েড প্রয়োগ করা হয় তা রান্নার তাপে নষ্ট হয় না।

প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রাণিস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. গিয়াস উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণত অস্বাভাবিক মোটাতাজা গরু অস্বাভাবিক স্থুল দেখায়, নিচের অংশে পানি জমে থাকে, থলথলে অবস্থা থাকে, মাংসল স্থানে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে আঙুল দেবে থাকে, চোখে নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো ঝিমুনির ভাব থাকে, চঞ্চলতা থাকে না, গতিবিধি থাকে নিস্তেজ ধরনের। রোদে থাকতে পারে না, ঘন ঘন পানি খায় এবং ঘন ঘন প্রসাব করে। এসব গবাদি পশুর কিডনি ও লিভার বিকল হয়ে যায়।

ড. গিয়াস উদ্দিন বলেন, টিটেনাস যেহেতু সিরাম বা প্রোটিন জাতীয় উপাদান তাই অসাধুচক্র এর অপপ্রয়োগ ঘটাতে পারে, যা গবাদি পশু ও মানুষের জন্য বিপজ্জনক।

প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আরেক কর্মকর্তা জানান, দেশে সাধারণত বিক্রয়যোগ্য গবাদি পশু মোটাতাজাকরণ কাজে স্টেরয়েড আইটেমের ডেক্সামেথাজন গ্রুপের বিভিন্ন ইনজেকশন প্রয়োগ হয়ে থাকে। এ ছাড়া ইউরিয়া খাওয়ানো হয়। বিশেষ করে কোরবানির আগে এ প্রবণতা বেড়ে যায়।

ড. রকিবুল ইসলাম বলেন, মানুষ ও গবাদি পশুর জীবন রক্ষার জন্য বিশেষ প্রয়োজনে পরিমিত মাত্রায় কিছু স্টেরয়েড ওষুধ ব্যবহার করার অনুমতি আছে। তার পরও মোটাতাজাকরণে এটা অনেকে ব্যবহার করে থাকে অধিক মুনাফার লোভে। গরু-ছাগল বা অন্য গবাদি পশুর দেহে স্টেরয়েড দেওয়া হলেও এর মাংস মানুষের জন্য নিরাপদ নয়। কারণ এটা তাপে নষ্ট হয় না, মানুষের দেহে যাবেই।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top