অবৈধ লেনদেন ও মুদ্রা পাচারের মামলায় সাতজন মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
বুধবার রাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। সিআইডি বলছে, রেমিটেন্সের অর্থ অবৈধভাবে বিকাশের মাধ্যমে হুন্ডি করার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে আটটি মামলা রয়েছে। তারা কোটি টাকার উপরে লেনদেন করেছে বলে পুলিশ বলছে।
দু’দিন আগে একই অভিযোগে আরো দু’জন বিকাশ এজেন্টকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি।
বিকাশ ও মোবাইল ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ২৮৮৬ জন এজেন্টের অস্বাভাবিক লেনদেন তদন্ত করার জন্য সিআইডিকে অনুরোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই তদন্তের সূত্রেই এই আটজন এজেন্টকে গ্রেফতার করা হলো।
কিন্তু বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক ভিত্তিক একটি আর্থিক লেনদেন প্রতিষ্ঠানে কিভাবে বিদেশ থেকে অর্থ পাচারে ব্যবহার করা হয়?
বিকাশের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, বিকাশ বা বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের একাউন্ট ব্যবহার করা হলেও, এসব একাউন্টে সরাসরি বিদেশ থেকে টাকা আসে না। কারণ বিদেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি থাকলেও বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের অন্য কোথাও সরাসরি বিকাশ থেকে লেনদেনের সুযোগ নেই।
বিষয়টিকে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ”মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য বা অন্য অনেক দেশে অনেক মানি এক্সচেঞ্জ বা অর্থ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তাদের দোকানে বিকাশ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখে। সেখানে থাকা বাংলাদেশী অভিবাসীরা মনে করে, এটাই বিকাশের শাখা। তাই তারা সেখানে দেশে সহজে টাকা পাঠানোর জন্য যান। সেখানে তারা দেশে থাকা কোনো স্বজনের ফোন নম্বর দেন, যে নম্বরে এই টাকা গ্রহণ করা হবে।”
তিনি বলছেন, ”এরপর এসব প্রতিষ্ঠান দেশে থাকা তাদের কোনো এজেন্টকে ওই নম্বরে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বিকাশ করার জন্য বলে দেন। সেই স্বজন হয়তো তখন তার মোবাইলের মাধ্যমেই টাকা পান। কিন্তু এক্ষেত্রে বিকাশ বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নাম ব্যবহার করা হলেও আসলে হুন্ডির মাধ্যমে টাকার লেনদেন হচ্ছে।”
সিআইডি যে ব্যক্তিদের গ্রেফতার করেছে, তারাও স্বীকার করেছে, প্রবাস থেকে আসা অর্থ তারা এভাবে বিকাশ ব্যবহার করে লেনদেন করেছে।
সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার শারমিন জাহান বলছেন, বিকাশের মতো মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে এই ব্যক্তিরা। এরা অনেকদিন ধরেই দেশের ভেতর অবৈধভাবে এই লেনদেন করে আসছে। এই আটজন এজেন্ট মিলে কোটি টাকার উপর অবৈধভাবে হুন্ডির টাকা লেনদেন করেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাংবাদিক সাইফুর রহমান গত অগাস্ট মাসে বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, সেখানে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠানে বিকাশের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেশে অবৈধভাবে অর্থ পাঠানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। প্রবাসী শ্রমিকদের বলা হতো যে, এখান থেকে বিকাশের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানো যায়। কিন্তু এর ফলে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয় সেখানকার মানি এক্সচেঞ্জগুলো। তাদের অনুরোধে সেখানকার কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে এরকম ২৫টি বাংলাদেশি দোকান বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশের সিআইডি তাদের তদন্তে দেখতে পেয়েছে, শুধুমাত্র বিদেশ থেকে যে টাকাই আসছে তা নয়, ইয়াবা বা মাদক ব্যবসার লেনদেনের টাকাও বিকাশ ব্যবহার করে দেশের বাইরে পাঠানো হচ্ছে।
সম্প্রতি টেকনাফের মানি লন্ডারিং আইনে দায়ের করা মামলার তদন্তে সিআইডি জানতে পারে, টেকনাফ থেকে ইয়াবা এনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রির পর, সেই বিক্রির টাকা আবার বিকাশ বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টেকনাফে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে হাতঘুরে টাকা চলে যায় মিয়ানমারেও।
বাংলাদেশে এখন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিলেও এই খাতের বড় অংশের লেনদেন ব্রাক ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির এক লাখ ৮০ হাজার এজেন্ট রয়েছে। সবগুলো ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট রয়েছে প্রায় ৫ লাখের বেশি।
মানি লন্ডারিংয়ের ব্যাপারে বিকাশের কর্তৃপক্ষ কতটা সচেতন? এটি ঠেকাতে তারা কি উদ্যোগ নিয়েছেন?
বিকাশের কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলছেন, ”আমরা কোনোভাবেই চাই না আমাদের নেটওয়ার্ক মানি লন্ডারিং বা কোন অবৈধ কাজে ব্যবহৃত হোক। এজন্য আমাদের বিশেষ একটি বিভাগও রয়েছে, যারা এরকম সন্দেহজনক লেনদেন মনিটরিং করে। সেখানে কোন তথ্য পেলে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে সরবরাহ করি। তারা সে অনুযায়ী তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এখন যেসব অভিযান চালানো হচ্ছে, সেগুলোও আমাদের দেয়া তথ্য এবং সহযোগিতায় হচ্ছে।”
তিনি বলছেন, যারা এরকম অপরাধে জড়িত, তাদের সবাই বিকাশ এজেন্ট নয়। আবার অনেকে একই সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট হিসাবেও কাজ করে। কিন্তু সার্বিকভাবে যেন বিকাশ বলে ডাকা হয়।
কেন অবৈধ পন্থায় টাকা পাঠান প্রবাসীরা?
সহজ উত্তর হলো, এক্ষেত্রে কাগজপত্র দরকার হয়না। মুদ্রা বিনিময় হারও বেশি।
বিকাশের এক কর্মকর্তা বলছেন, অনেক দেশেই অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের চুক্তি আছে, যেখান থেকে প্রবাসীরা বৈধভাবে টাকা পাঠাতে পারেন। কিন্তু তারপরও অনেকে এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের কাছে যান। কেউ কেউ হয়তো না জেনে বা বুঝতে না পেরে যান। আবার অনেকে সেখানে যান এ কারণে যে, তিনি হয়তো অবৈধভাবে দেশটিতে আছেন বা অতিরিক্ত কাজ করেছেন। হয়তো তার আয়ের সপক্ষে যথেষ্ট কাগজপত্র নেই। আবার এসব প্রতিষ্ঠান ডলার, দিনার বা রিঙ্গিত বিনিময়ে হারও বেশি দিচ্ছে।
তাদের এসব টাকা হুন্ডিকারীরা মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে একেবারে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। এ কারণে অনেকে এসব প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হন।
তবে এ বিষয়ে তাদের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে বলে বলছেন বিকাশ কর্মকর্তারা।
সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, এই আটজনের কাছ থেকে অনেক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আরো বেশ কয়েকজনের ব্যাপারেও তাদের তদন্ত চলছে।