রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘পরমাণু শক্তি আমরা শান্তির জন্যই ব্যবহার করবো। পরমাণু শক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। সেটা গ্রামের মানুষের কাছে যাবে। তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হবে।’
রবিবার (১০ অক্টোবর) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (আরএনপিপি) প্রথম পারমাণবিক চুল্লিপাত্র স্থাপন কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কানফারেন্সের মাধ্যমে এই কাজ উদ্বোধন করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আশা করি ২০২৩ সালের মধ্যে এখান থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট শুরু করতে পারবো।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়ে যাওয়ার পর আমরা দক্ষিণাঞ্চলে জায়গা খুঁজছি। দক্ষিণাঞ্চলে শক্ত মাটির জায়গা পাওয়া খুবই কঠিন। তারপরও বিভিন্ন দ্বীপসহ ওই অঞ্চলে জরিপ করছি। আরেকটা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবো, যেখানে ভালো জায়গা পাই। আমার ইচ্ছা, পদ্মার ওপারেও করবো। আশা করি, এ ব্যাপারে কোনও অসুবিধা হবে না।’
তিনি বলেন, ‘সেখানে যদি আমরা আরেকটা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারি। তাহলে বিদ্যুতের জন্য আর কোনও অসুবিধা হবে না। তারপরও আমরা বহুমুখী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে যাচ্ছি এ জন্য যে বিদ্যুৎ সুবিধা যেন মানুষ পায় এবং অব্যাহত থাকে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়তে চাই। এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। কিন্তু এখানে থেমে গেলে চলবে না। ৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়বো। ২০৭১ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন হবে। নিশ্চয় নতুন প্রজন্ম একটি সুন্দর, উন্নত, সমৃদ্ধশালী ও আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন করবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ২১০০ সাল পর্যন্ত ডেলটা প্ল্যানও করে দিয়েছি, যাতে দেশকে আর কোনোদিন পিছিয়ে পড়তে না হয়। আর যেন কোনও শকুনির থাবা না পড়ে বাংলাদেশের ওপর। উন্নতি ও অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য গতিতে যাতে এগিয়ে যায়, সেটাই আমরা চাই।’
দেশের ৯৯ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে বিষয়টি আবারও জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষের যতটা আর্থিক সচ্ছলতা আসবে, তাদের চাহিদাও বাড়তে থাকবে। তাছাড়া আমরা ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। সেখানে শিল্পায়ন হবে। যত বেশি শিল্পায়ন হবে, ততবেশি বিদ্যুতের চাহিদাও তৈরি হবে। সেটা মাথায় রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনের পরিকল্পনা আমরা নিয়েছি।’
বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন আইন প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই আইন করে আমরা বেসরকারি খাতটা উন্মুক্ত করে দিয়েছি। শিল্পপতিরা যাতে ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারেন। সেটাও আমরা অনুমোদন দিয়েছি। সে ক্ষেত্রে আমরা এটা বিশেষ আইনও করি।এই ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে।’
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার সহযোগিতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি যখন রাশিয়ায় যাই, তাদের রাষ্ট্রপতি পুতিনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ হয়। তিনি আমাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে দেবেন, এ কথাটা বলেন। তাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আলাপ হয়।’ তিনি বলেন, ‘সেখানে আমার কতগুলো প্রশ্নও ছিল এর নিরাপত্তা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে। কারণ, বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্ভব না। আমাদের যে চুক্তি হয়, তাতে এটাও নিশ্চিত করা হয়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সব সময় রাশিয়াই করবে।’
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে আণবিক কমিশনে কর্মরতদের অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা রাশিয়াতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। ভারতেও দিচ্ছি। কারণ, সেখানে একই রকম আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। আর এখানে কাজ করতে গিয়ে আমাদের দেশের মানুষ বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা পাচ্ছে।’
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তার বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখানে চার স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরা করেছি। পারমাণবিক চুল্লির কাছে যারা কাজ করবেন তাদেরও অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের দরকার।’
তিনি বলেন, ‘পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ হয় না। এখানে সব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। তাই খুব একটা দুর্ঘটনা ঘটার সুযোগ নেই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের মাটি খুবই নরম। এখানে চুল্লি বসাতে গেলে ওজন নিতে হয়। সেটার জন্য এই মাটিটাকেও নতুনভাবে তৈরি করতে হয়েছে। নদী ড্রেজিং করতে হয়েছে। সেই ভলগা থেকে পদ্মা আমরা পাড়ি দিচ্ছি। সেটাতে আমাদের ভবিষ্যৎ ব্যবসা-বাণিজ্যের দুয়ার খুলে গেলো বলে মনে করি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে কোনও কিছু করতে গেলে এত সমালোচনা হয়। নানাভাবে, নানাজনে, কেউ বুঝে-কেউ না বুঝে অনেক কথা বলেন। অনেক কথা লিখে ফেলেন। টকশোতে অনেক কথাও হয়। টক-মিষ্টি-ঝাল মিশিয়ে অনেক কথা হয়। এটা আমাদের দেশের একটা নিয়ম ও চরিত্র। কোনও কিছু করতে গেলে কেউ এটার মধ্যে খুঁত খোঁজে।’
তিনি বলেন, ‘তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য শুধু জমি নিয়েছিল। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কোনও উদ্যোগ তারা নেয়নি। বরাদ্দকৃত অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। সেখানে তারা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করে।’
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কিন্তু সেটা করে যেতে পারেননি। পঁচাত্তরের পরে এই কর্মকাণ্ড থেমে যায়। সে সময় সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে সামরিক আইন দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল একের পর এক। কখনও সরাসরি মার্শাল ল, কখনও তার আওতায়। কিন্তু তারা আর কোনও উদ্যোগ নেয়নি। কারণ, এ ব্যাপারে অনেক কাজ করতে হয়। সেগুলো করার মতো তাদের আন্তরিকতা, ইচ্ছা, অভিজ্ঞতা ও চেষ্টা ছিল না।’
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ পুনরায় গ্রহণ করা হয় বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। সে সময় সরকারের নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন তিনি। কিন্তু পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত সরকার সেটা বন্ধ করে দেয় বলে জানান শেখ হাসিনা।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন, মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান। বক্তব্য রাখেন, রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ। রূপপুর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন। এটি রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় নির্মিত হচ্ছে।