বছর দুই আগেও যুক্তরাষ্ট্রে দলীয় নেতাকর্মী ও সুধীজনদের সামনে উপস্থিত হয়ে সরাসরি বক্তব্য রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু কোভিড-১৯ এর কারণে পরিস্থিতি বদলে গেছে। মাঝে এক বছর আসতেও পারেননি। অনেকটা কঠিন পরিস্থিতিতেও এবার তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন, নানা ইস্যুতে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের অবস্থান। তবে বিশেষ সতর্কতার অংশ হিসেবে নেতাকর্মীদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করার সুযোগ হয়নি। শুক্রবার নিউইয়র্ক সময় রাত ৮টায় তাই একটি ভার্চুয়াল সভার শুরুতেই অনেকটা আক্ষেপ করেই প্রধানমন্ত্রী বললেন, “আপনাদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে পারলেই অনেক ভালো লাগতো।”
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের আয়োজনে এই ভার্চুয়াল নাগরিক সংবধর্নার আয়োজন করা হয়। লাগোর্ডিয়া ম্যারিয়ট হোটেলে আয়োজিত সভায় যোগ দেয়ার জন্য কেবল নিউইয়র্ক নয়, অন্যান্য স্টেট থেকেও বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত হন। সেখানে তখন উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। রাত ৮টার কিছু সময় পর প্রধানমন্ত্রী শেখ তাঁর হোটেল স্যুইট থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন। তখন উপস্থিত নেতাকর্মীরা বিপুল করতালি ও শ্লোগান দিয়ে প্রিয় নেত্রীকে বরণ করে নেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে জাতিসংঘের অধিবেশনে এবার তার অংশগ্রহণের নানা দিক তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে তার সরকারের নেয়া বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথাও জানান প্রবাসীদেরকে। বিশেষ করে করোনা মহামারীতে দেশের মানুষের জীবনমান রক্ষায় কি কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেইসব তুলে ধরেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি রাজনৈতিক বক্তব্যও রাখেন এসময়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না তারা মূলত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশে এবং বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। তারা দেশের জনগণের শত্রু। তিনি বলেন, বিদেশে অবস্থা করা কিছু লোক সরকারের সমালোচনা করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে ব্যস্ত। এমন সময়ে তারা এসব করছে, যখন আওয়ামী লীগ দেশকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে গেছে। কেউই যাতে দেশে মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সকলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, রাজনীতি ভোগের জন্য নয় বরং এটি আত্মত্যাগের জন্য। তিনি বরাবরই মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের রাজনীতি করে এসেছেন। জিয়া, এরশাদ এবং খালেদা জিয়া কখনো জনগণের কল্যাণের কথা ভাবেননি। বরং তারা ক্ষমতাকে ভোগ এবং দ্রুত অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করতেন বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
তিনি বলেন, “আমি শুনলাম, কেউ কেউ বলেছে, আমি নাকি কত বস্তা, না কত ট্রাঙ্ক বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে না কি বিমানে এসেছি। যারা এই কথাগুলো বলেছে, তারা যখন এই বিষয়টা জানে, তো সেই ট্রাঙ্কগুলো গেল কোথায়, রাখলাম কোথায়, কী হল? সেই খোঁজটা তারা একটু দিক।”
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে দেড়শ সুটকেস নিয়ে সৌদি আরব চলে গিয়েছিল এবং সেখানে লকার ভাড়া করে নাকি অনেক জিনিস রেখে এসেছিল শোনা যায়। তখন সেটা প্রচার হয়েছিল”।
“আর খালেদা জিয়ার মন্ত্রী বাবর (লুৎফুজ্জামান বাবর) যখন এখানে আসে, এয়াপোর্টে ধরা পড়েছিল কয়েক লক্ষ ডলার নিয়ে। পরে অ্যাম্বাসি থেকে লোক গিয়ে কোনোমতে মুচলেকা দিয়ে তাকে ছাড়িয়েছিল।”
তিনি বলেন, “সমালোচনাকারীরা একটা কথা ভুলে যায় যে আমি জাতির পিতার মেয়ে। আমরা দেশের জন্য কাজ করি, আর ক্ষমতাটা আমাদের কাছে দেশসেবা করা, মানুষের সেবা করা। আমরা অর্থ সম্পদের জন্য লালায়িত না।”
বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, “জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তাদের সন্তানরা ক্ষমতাটাকে ভোগের জায়গা বানিয়েছে। ক্ষমতাটাকে তারা নিজেদের ভাগ্য গড়ার জায়গা বানিয়েছে”।
“আর আমাদের কাছে ক্ষমতা হচ্ছে মানুষের ভাগ্য গড়া, বাঙালির ভাগ্য গড়া, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য গড়া। দেশের মানুষের উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে সরকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আজ সমগ্র বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে উঠেছে। কিছু মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারকে অবৈধ হিসেবে আখ্যায়িত করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার প্রশ্ন হল তারা কিভাবে এই কথাগুলো বলার সুযোগ পায়?’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, তারা তাঁর সরকারের তৈরি ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগের সমালোচনার সুযোগ পাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারা জনগণের অর্থ সম্পদ লুট করে, খুন করে অথবা অস্ত্র পাচার করার অথবা গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি, সেই আসামিদের হাতের টাকা খেয়েই তো তারা এই বড় বড় কথা বলে আর তারাই বলে আওয়ামী লীগ অবৈধ।”
জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলকে আদালত অবৈধ বলে রায় দিয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “তো অবৈধ সরকারের তাঁবেদারি করে আওয়ামী লীগকে বা আওয়ামী লীগ সরকারকে অবৈধ বলায় অধিকারটা তাদেরকে কে দিল?
“জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে এবং বিএনপির যদি শক্তি থাকত তাহলে তারা নির্বাচন করত।”
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে নিউইয়র্কে আসা প্রসঙ্গেও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ড্রিমলাইনার বিমানে করে দুটি কারণে নিউইয়র্কে এসেছেন। প্রথম কারণ হচ্ছে- অন্য এয়ারলাইন্সের পরিবর্তে দেশী একটি এয়ারলাইন্সকে অর্থ দেয়া। তিনি বলেন, “এভাবে আমাদের নিজের হাতেই এ ধরনের অর্থ থেকে যায়”।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “যদি একটি বিমান উড্ডয়ন না করে বিমানবন্দরেই থেকে যায়, তাহলেও প্রতিদিন একটি বিরাট অংকের টাকা খরচ হয়। এমনিতেই করোনা ভাইরাসের কারণে বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো স্থগিত রয়েছে”। তিনি আরো বলেন, “তাঁর সরকার ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে পুনরায় বিমান পরিচালনা শুরু করতে একটি প্রক্রিয়া শুরু করেছে”।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগ করার অহবান জানিয়েছেন। ভার্চুয়াল সংবর্ধনার পর গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভায় শেখ হাসিনা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিনিয়োগ আকর্ষণে তাঁর সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। প্রবাসীদের সেইসব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করার কথা বলেন তিনি। এসময় সাংবাদিকদের বেশ কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেন তিনি।
ভার্চুয়ালি আয়োজিত এই মতবিনিময় সভায় রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু সসমস্যা, ভ্যাকসিন কূটনীতিসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে আসে। ভারসাম্যহীন উন্নয়ন টিকবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য ব্যবস্থা না নিলে সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে না।
তিনি সকলকে স্মরণ করিয়ে দেন যে কভিড-১৯ মহামারীর পর থেকে তিনি দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন, বাংলাদেশের জন্য শুধু নয়, অন্য দেশের জন্যও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। যেন এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী না থাকে। দেশে ও বিদেশে শত্রু তৈরি এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে একটি প্রশ্ন করা হয় শেখ হাসিনাকে। উত্তরে তিনি বলেন, “ন্যয় ও সত্যের পক্ষে যখন কথা বলবো স্বাভাবিকভাবেই জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হবে। কিন্তু সেজন্য সত্যটা বলবো না, ন্যয়সঙ্গত কথাটা বলবো না এটা তো হয় না। সেজন্যেই সেটা আমি করে যাচ্ছি। বার বার গ্রেনেড হামলাসহ নানা কিছুর মুখোমুখি আমাকে হতে হয়েছে, কতবার তো কারাগারে বন্দী হতে হয়েছে। সেগুলো জানি আমি। এবং জেনেই কিন্তু আমার পথচলা”।
সাংবাদিকদের কাছে প্রত্যাশা সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, “সংবাদপত্র সমাজের আয়না। সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। সুতরাং, নির্বিচারে সমালোচনা না করে একটি গঠনমূলক ভূমিকা পালন করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাংবাদিক ও সংবাদপত্রে মিথ্যা অভিযোগ করে কাউকে খাটো না করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করতে হবে।”