মেঘে ঢাকা পড়ল মিরপুরের আকাশ, ধোঁয়াটে অন্ধকার দূর করতে ভরদুপুরেই জ্বালিয়ে দেওয়া হলো ফ্লাডলাইট। মুশফিকুর রহিম আর মুমিনুল হকের আলোকিত ব্যাটিং ফ্লাডলাইটের উজ্জ্বলতাকেও যেন ছাপিয়ে গেল! মেঘে ঢাকা আকাশের মতো জিম্বাবুয়ে শিবিরে ‘পরাজয়ের শঙ্কা’ নামের যে অন্ধকার বাসা বেঁধেছে, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেটা ঘনীভূত হলো আরও।
প্রতিপক্ষকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে স্বপ্নীল এক দিনই কাটাল বাংলাদেশ। যে দিনটাতে সবকিছুই হলো নিজেদের চাওয়া মতো। কথা রেখে বড় ইনিংস খেললেন দলপতি মুমিনুল। তার সেঞ্চুরি ছাপিয়ে ক্যারিয়ারে আরও একটি ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নিলেন মুশফিক। এই যুগলের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে ঢাকা টেস্টের তৃতীয় দিনটা হয়ে উঠল রঙিন, আলোকোজ্জ্বল। শেষ বিকালে জোড়া আঘাত হেনে দিনটাকে আরও রঙিন করে তুললেন নাঈম হাসান। টেস্ট ক্রিকেটে পরাজয়ের যে অন্ধকার গত ১৫ মাস আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল বাংলাদেশকে, সেই অন্ধকার ফুরে ফুটে উঠেছে জয়ের আলোক রেখা। ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ঢাকা টেস্টে তৃতীয় দিন শেষেই জয়ের সুবাস পেতে শুরু করেছে টাইগাররা।
জিম্বাবুয়ের প্রথম ইনিংস ২৬৫ রানে আটকে দেওয়ার পর মুমিনুলের রেকর্ড ছোঁয়া সেঞ্চুরি আর মুশফিকের মহাকাব্যের সঙ্গে লিটন দাসের হাফসেঞ্চুরিতে ৬ উইকেটে ৫৬০ রান তুলে নিজেদের প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে বাংলাদেশ। ২৯৫ রানে এগিয়ে থেকে স্বাগতিকরা শেষ বিকালে ব্যাটিংয়ে পাঠায় জিম্বাবুয়েকে। লক্ষ্য ছিল একটি-দুটি উইকেট তুলে নেওয়া। অফস্পিনার নাঈম সেই লক্ষ্যটা দারুণভাবেই পূরণ করে দিয়েছেন। ইনিংসের দ্বিতীয় এবং তৃতীয়, টানা দুই বলে প্রিন্স মাসভাউরে আর নাইটওয়াচম্যান ডোনাল্ড তিরিপানোকে ফেরত পাঠিয়েছেন সাজঘরে। কেভিন কাসুজা আর ব্রেন্ডন টেলর আর কোনো বিপদ হতে না দিলেও পরাজয়ের শঙ্কা বাড়িয়েই দিন শেষ করেছে ৫ ওভারে ২ উইকেটে ৯ রান তোলা জিম্বাবুয়ে। ইনিংস পরাজয় এড়িয়ে বাংলাদেশকে দ্বিতীয়বার ব্যাটিংয়ে পাঠাতে আরও অন্তত ২৮৬ রান করতে হবে তাদের।
তার আগেই জিম্বাবুয়ের বাকি ৮ উইকেট তুলে নেওয়ার লক্ষ্যেই ছক কষছে টাইগার বোলাররা। তাহলেই ধরা দেবে জয়, সবশেষ ছয় টেস্টে যেটা ধরা দেয়নি। শুধু পরাজয়ের হতাশাতেই সময় কেটেছে। এবার সেই বৃত্ত ভাঙার পালা। মঞ্চটা গড়ে দিয়েছেন ব্যাটসম্যানরাই। আরও নির্দিষ্ট করে বললে মুশফিক আর মুমিনুল। ৩ উইকেটে ২৪০ রান নিয়ে সোমবার তৃতীয় দিনে ব্যাটিং শুরু করেন দুজন। প্রায় দেড় বছর আগে এই মিরপুরেই দুই দলের সবশেষ সাক্ষাতে যে কীর্তি গড়েছিলেন তারা, সেটারই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন। সেদিন দেড়শ ছাড়ানো ইনিংস খেলেছিলেন মুমিনুল, তামিম ইকবালের নবম সেঞ্চুরির রেকর্ডে ভাগ বসিয়ে এদিন তিনি খেলেছেন ১৩২ রানের ইনিংস। সেদিন ২১৯ রান করা মুশফিক এদিন করেছেন ২০৩ রান, টেস্টে এটি তৃতীয় ডাবলসেঞ্চুরি তার। টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে একটি করে ডাবলসেঞ্চুরি আছে তামিম আর সাকিব আল হাসানের।
২০১৮ সালের সেদিন মুমিনুল-মুশফিক গড়েছিলেন ২৬৬ রানের জুটি। এবারের জুটি ২২২ রানের। জুটি গড়ার পথে জিম্বাবুয়ের বোলারদের রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছেন তারা। ১৪টি চারের মারে ২৩৪ বল খেলে ১৩২ রানে মুমিনুল এনডিলভুকে ফিরতি ক্যাচ দিলে ভাঙে জুটিটা। মুশফিক ততক্ষণে ক্যারিয়ারের সপ্তম সেঞ্চুরি তুলে সেটাকে ডাবলে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা সেরে ফেলেন। মোহাম্মদ মিঠুন (১৭) দ্রæত বিদায় নিলেও হাফসেঞ্চুরিয়ান লিটনকে নিয়ে (৫৩) গড়েন ১১১ রানের জুটি। সিকান্দার রাজার বলে আউট হওয়া লিটন অবশ্য মুশফিকের ডাবল সেঞ্চুরির বাঁধভাঙা উদযাপনটা মাঠে দাঁড়িয়ে দেখতে পারেননি। উইকেটে তখন মুশফিকের সঙ্গী ছিলেন তাইজুল (১৪*)।
২৮টি চারের মারে ৩১৮ বলে ২০৩ রানের ইনিংসটা সাজান মুশফিক। এই ইনিংস খেলার পথে তামিমকে (৪৪০৫) টপকে টেস্টে দেশের পক্ষে সর্বাধিক রানের মালিকও বনে গেছেন তিনি। মুশফিকের রান এখন ৪ হাজার ৪১৩। ইনিংস ঘোষণার আগে ৫৬০ রান তুলে নিজেদের এক রেকর্ড নতুন করে লিখেছে বাংলাদেশও। ঘরের মাঠে টেস্টে তাদের আগের সর্বোচ্চ ছিল ৫৫৬, ২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। এদিন সেটাকে ছাড়িয়ে গেছে মুমিনুলের বাংলাদেশ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর (তৃতীয় দিন শেষে)
জিম্বাবুয়ে : ২৬৫ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ ওভারে ৯/২ (মাসভাউরে ০, কাসুজা ৮*, তিরিপানো ০, টেলর ১*; নাঈম ২/৪)
বাংলাদেশ : প্রথম ইনিংসে ১৫৪ ওভারে ৫৬০/৬ ডিক্লে. (মুমিনুল ১৩২, মুশফিক ২০৩*, মিঠুন ১৭, লিটন ৫৩, তাইজুল ১৪*; তিরিপানো ১/৯৬, নিয়োচি ১/৮৭, রাজা ১/১১১, তিসুমা ১/৮৫, এনডিলভু ২/১৭০)
মুশফিক-মুমিনুলে রঙিন দিন
Share!