Friday , 1 November 2024
সংবাদ শিরোনাম

খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, বাড়ছে আটা-ময়দার চাহিদা

আটা-ময়দার তৈরি খাবারের দিকে ঝুঁকছে মানুষ। ডায়াবেটিস ও স্বাস্থ্যগত কারণেও অনেকে ভাতের বদলে খাচ্ছেন রুটি। চালের তুলনায় খরচ কম হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষুধাও মেটাচ্ছে আটা। সব মিলে আটা-ময়দার চাহিদা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এই আটা-ময়দা নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের সওদাপাতি

সরকারি চাকরিজীবী আব্দুস সালামের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীরে রোগের সংক্রমণ বেড়েছে। ডাক্তারের পরামর্শে সুস্থ থাকার প্রয়াসে তিনি একবেলা ভাত আর দুবেলা রুটি খাওয়ার অভ্যাস করছেন। আব্দুস সালামের মতো অনেকেই এখন রুটিতে ঝুঁকছেন।

বিগত কয়েক বছরে দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে বেশ পরিবর্তন এসেছে। এখন আটা-ময়দার তৈরি রুটি, বেকারি পণ্য, ফাস্ট ফুডসহ স্ট্রিট ফুডের কদর বাড়ছে দ্রুত। এসব পণ্যের কাঁচামালের মূল উপাদান হলো গম। দেশে গমের উৎপাদন হলেও চাহিদার বেশির ভাগই মেটানো হয় আমদানি থেকে। আর চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে আমদানি।

তিনবেলা ভাতের পরিবর্তে এখন স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ অন্তত একবেলা আটার রুটিতে অভ্যস্ত হচ্ছে। ভাতের পরিবর্তে রুটিতে প্রোটিন বেশি হওয়া শক্তির জোগান আসে অনেক।

দেশে আটার চাহিদা বাড়ার আরেক কারণ প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা বৃদ্ধি। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের কেক, রুটি, বিস্কুট, টোস্ট, নুডলস, চিপস ও অন্যান্য বেকারি পণ্য, ফাস্ট ফুড ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরিতে আটা ব্যবহৃত হয়।

স্থানীয় মিল মালিকদের হিসাবের বাইরে দেশে প্রতি মাসে ২৫ হাজার মেট্রিক টন আটা-ময়দার চাহিদা রয়েছে। এটা কেবল প্যাকেটজাত বা ব্র্যান্ডেড পণ্যের হিসাব। এর বাইরে স্থানীয় আটা উৎপাদনকারী মিলাররাও ভোক্তাদের আটার চাহিদা মেটাচ্ছে। দেশে উৎপাদিত গমের পাশাপাশি বিদেশ থেকে গম আমদানি করে আটার চাহিদা পূরণ করা হয়। বিশ্ববাজারে গমের দামের ভিত্তিতে আটার দাম নির্ধারিত হয়। ইউক্রেন, রাশিয়া, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে গম আমদানি করা হয়।

বাজারে একসময় নূরানী আটা-ময়দা-সুজি বেশ চলত। পরবর্তী সময়ে বসুন্ধরা, সিটি, মেঘনা, ইফাদ, এসিআই ও আকিজসহ বড় বড় শিল্প গ্রুপ আটা, ময়দা ও সুজির ব্যবসায় যুক্ত হয়। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্র্যান্ডেড পণ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিলেও স্থানীয় মিলাররা তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। কারণ ছোট ব্যবসায়ীরা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পণ্য তৈরি ও বাজারজাত করে। এতে তাদের খরচের পরিমাণও বাড়ে। আর বড় বড় প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্যের খরচও তুলনামূলকভাবে অন্যদের চেয়ে কম হওয়ায় দাম কমিয়ে বিক্রি করতে পারে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের হিসাব মতে, দেশে প্রতি কেজি খোলা আটার দাম (সাদা) ২৭ থেকে ৩০ আর প্যাকেট করা আটার দাম ৩২ থেকে ৩৬ টাকা। এক মাস আগে এই আটার দাম ছিল ২৬ থেকে ৩৬ টাকা। খোলা আটা (সাদা) ২৬ থেকে ৩০ টাকা। আর প্যাকেটজাত এই আটার দাম ছিল ৩২ থেকে ৩৬ টাকা। প্যাকেটজাত আটার দাম না বাড়লেও অন্য দুই আটার দাম বেড়েছে প্রায় দুই টাকা। এদিকে প্রতি কেজি ময়দার দাম ছিল ৩৪ থেকে ৪৮ টাকা। ময়দার (খোলা) দাম প্রতি কেজি ৩৪ থেকে ৩৮ টাকা আর প্যাকেটজাত ময়দার দাম প্রতি কেজি ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। এর বাইরে ওএমএসের মাধ্যমে খোলাবাজারে সরকার নিয়মিতভাবে ১৭ টাকা কেজি দরে আটা বিক্রি করে।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশের গম আমদানি হচ্ছে। বিগত বছরের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে গমের আমদানি বেশি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে আটার মূল উপাদান গম আমদানি হয়েছে ২৫ লাখ ২৬ হাজার ৫১০ মেট্রিক টন। যার মধ্যে সরকার আমদানি করেছে এক লাখ ৬৭ হাজার ৬৬০ মেট্রিক টন আর বেসরকারি উদ্যোক্তা বা মালিকরা আমদানি করেছেন ২৩ লাখ ৫৮ হাজার ৮৫০ মেট্রিক টন।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের হিসাবে দেখা যায়, এক বছরে দেশে গম আমদানি করা হয়েছে ৫৮ লাখ ৮০ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন। যার মধ্যে সরকার আমদানি করে পাঁচ লাখ পাঁচ হাজার ৬০ মেট্রিক টন আর বেসরকারিভাবে বা সরকারের বাইরে আমদানি করা হয় ৫৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৯০ মেট্রিক টন।

দেশে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গম ও গমজাত পণ্য আমদানি হয়েছিল ৩২ লাখ টন। এর আগের বছরে দেশে সার্বিক গমের চাহিদা এমনই ছিল। তবে এই সময়ের পর থেকে ক্রমেই বেড়েছে গমের আমদানি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ৫৭ লাখ টন গম আমদানি হয়।

বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য নিয়ে কাজ করা ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য বলছে, ২০১৪ সালের মে মাসে বিশ্ববাজারে প্রতি টন গমের দাম ছিল ৩৩৪ ডলার। এর পর থেকে এই দাম কমতে কমতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ১৪১ ডলার পর্যন্ত নেমে যায়। এর পর থেকে আবারও গমে দাম বাড়তে শুরু করে। সদ্য শেষ হওয়া ২০১৮ সালের আগস্টে প্রতি টন গমের দাম দাঁড়ায় ২৩৬ ডলার, যা জুলাই মাসের চেয়ে ৮.৪২ শতাংশ বেশি।

সম্প্রতি দেশে চালের দাম বাড়তির দিকে। আর এই দাম বাড়ার কারণে বিকল্প খাবার হিসেবে গমের চাহিদা বেড়েছে। চালে প্রোটিন রয়েছে ৭ শতাংশ আর আটায় বা গমে ৯ থেকে ১৪ শতাংশ। আবার ভাতের চেয়ে আটায় কার্বোহাইড্রেটের মাত্রাও কম। আটা-ময়দা থেকে তৈরি রুটি ও অন্যান্য খাবার শুকনো, নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও কম থাকে। মানুষ আগের তুলনায় স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে সেদিকেই ঝুঁকছে। নিম্ন আয়ের মানুষ ভাতের ওপর মূলত নির্ভরতা কমাতে আটার রুটিতে ভর করছে। চালের দাম বেশি হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাতের বদলে রুটি খাওয়া বেড়েছে।

বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ  ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রডাক্টস লিমিটেডের হেড অব ডিভিশন, মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস, রিটেইল এম এম জসিম উদ্দীন কালের কণ্ঠ’কে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে একটা ধারণা ছিল, ভাত ছাড়া চলতেই পারবে না  কিন্তু সেটার পরিবর্তন হয়েছে। এখন ভাতের পরিবর্তে আটা বা রুটিতে অভ্যস্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষও এখন রুটিতে অভ্যস্ত হচ্ছে।’

ভাতের চেয়ে রুটিতে অভ্যস্ত হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চালের অর্ধেক দামে মিলছে এক কেজি আটা। যেখানে এক কেজি চাল কিতে ৬০-৬৫ টাকা প্রয়োজন, সেখানে অর্ধেক দাম বা ৩৪ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে এক কেজি আটা, যা চালের সমপরিমাণ বা বেশি উপযোগ পাওয়া সম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘এই খাতে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা বসুন্ধরার পণ্যের গুণগত মান বজায় রেখে ভোক্তার চাহিদা পূরণ করছি। বিশ্ববাজারে গমের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়া সত্ত্বেও আমরা দাম বাড়াইনি।’ ঊর্ধ্বমুখী অব্যাহত থাকলে দাম সমন্বয় করার প্রয়োজন হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top