ততক্ষণে নিভে গেছে ফ্লাডলাইটের আলো। কয়েকটি বাতি যা জ্বলছে, সেটি অন্ধকারকে আরো গাঢ়ই করে শুধু। বিকেলে শেষ হওয়া ম্যাচে সন্ধ্যা পেরিয়ে স্টেডিয়ামজুড়ে শ্মশানের সুনসান নীরবতা। পেছন দিকে মাটি খোঁড়ার যন্ত্রের একঘেয়ে কর্কশ শব্দ শুধু। শ্মশানে রাত জাগা পাখির ডাকে যেমন নৈঃশব্দ দূর হয় না, আরো যেন বাড়িয়ে দেয়— ঠিক তেমনি ওই শব্দেই নীরবতা হয় প্রকট।
ঠিক যেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের মতো। ঠিক যেন সাকিব আল হাসানের বিপরীতে সতীর্থদের ব্যাটিংয়ের মতো।
৪৩ বলে ৬১ রানের ইনিংস স্বাগতিক অধিনায়কের। আট বাউন্ডারি ও দুই ছক্কার মালায় গাঁথা সেই ইনিংস। ব্যাটিং লাইনের অন্যরা যেন ধুলায় লুটানো ফুল। ব্যাটিং অর্ডারের প্রথম পাঁচে সাকিব ছাড়া অন্য চারের স্কোর দেখুন—তামিম ইকবাল ৫, লিটন দাশ ৬, সৌম্য সরকার ৫ এবং মুশফিকুর রহিম ৫। অধিনায়কের ফুঁসতে থাকাটা তাই খুব স্বাভাবিক। ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে আসেননি, তবে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সাকিব ঠিকই উগরে দেন নিজের রাগ-ক্রোধ-ক্ষোভ, ‘টস ছাড়া বাদবাকি কিছুই আজ ঠিক হয়নি। ভালো ব্যাটিং করতে পারিনি, ভালো বোলিং করতে পারিনি। উইকেট ভালোই ছিল; সেখানে অন্তত ১৭৫ রান করা উচিত ছিল আমাদের। কেন যে সেখানে ভালো করতে পারেনি, সেটি অন্য ব্যাটসম্যানদের জিজ্ঞেস করুন। আমি তো সবার হয়ে উত্তর দিতে পারব না।’
সেই ব্যাটসম্যানদের হয়ে উত্তর দিতে আসেন নিল ম্যাকেঞ্জি। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচ অনুমিতভাবেই পাশে দাঁড়ান শিষ্যদের। ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে অসহায়ত্বের প্রকাশটা প্রকট হলেও সেটিকে বড় করে দেখতে নারাজ তিনি, ‘ফাস্ট বোলিংয়ের মুখোমুখি হওয়াটা সমস্যা না। তবে মনে হচ্ছে না, আমরা দ্রুত শিখতে পারছি। কট্রেল ও থমাসের বলে বাড়তি গতি ছিল। তবে সাকিব দেখিয়েছে আমরা ওদের গতি আরেকটু ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারতাম। তা না করে আমরা একটু বেশি আক্রমণত্মক হওয়ার চেষ্টা করেছি।’ গতির সামনে ভয় পেয়ে ব্যাটসম্যানরা উইকেট না দেওয়াতেই যেন স্বস্তি ম্যাকেঞ্জির, ‘যদি ওপরে ওঠা বলে গ্লাভস লাগিয়ে কিংবা লেগস্টাম্পের দিকে সরে গিয়ে অথবা গতিতে পরাস্ত হয়ে নাকের কাছ দিয়ে যাওয়া বল হতো, তাহলে আমি উদ্বিগ্ন হতাম। আজকের ব্যাপারটি বরং আমার কাছে মনে হয়েছে অতি আত্মবিশ্বাসের ফল। তিনটি আউট দেখুন না। ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারের বেশি গতির বলে লিটন দাশ উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। অমনটা করতে অনেক সাহস এবং নিজের ওপর বিশ্বাস লাগে। ফর্মে থাকা তামিম সামনে খেলতে চেয়েছে। সৌম্যও তাই।’
তবে আগুনের জবাব যে সব সময় আগুন দিয়ে দেওয়া যায় না, সেটি কে বোঝাবে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের! কখনো কখনো আগুনের জবাব তো পানিতেও হয়। সেটিই বলার চেষ্টা ম্যাকেঞ্জির, ‘টি-টোয়েন্টি খেলার ধরনই এই যে সবাই আক্রমণ দিয়েই আক্রমণের মোকাবেলা করতে চায়। এর চেয়ে বরং বলের গতি ব্যবহার করে স্কয়ার পেছনে খেলার চেষ্টা করাই উচিত ছিল এই উইকেটে। আসলে ব্যাটসম্যানদের শর্ট বল খেলার সামর্থ্য আমাকে চিন্তায় ফেলছে না। বরং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ফলেই অমনটা হয়েছে। আগুনের জবাব আগুন দিয়েই দিতে চেয়েছে। কিন্তু কখনো কখনো অন্যভাবেও খেলতে হয়।’ শর্ট বলের বিপক্ষে বাংলাদেশের চিরচেনা দুর্বলতার কথা যে ওয়ানডে সিরিজের মধ্যে বলেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওই ফরম্যাটের অধিনায়ক রোভম্যান পাওয়েল, সেটি মনে করিয়েও বিচলিত করা যায় না এই দক্ষিণ আফ্রিকানকে, ‘পাওয়েলের মন্তব্য আমি পড়িনি। আমি মনে করি, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে শর্ট বল করা একটি আক্রমণাত্মক কৌশল। সেটি চৌকসভাবে সামলাতে হয়। আমার তাই শর্ট বলের বিপক্ষে না পারাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড়
করাব না।’
অধিনায়কের মতো সীমিত ওভারের ব্যাটিং কোচের তাই অভিন্ন উপলব্ধি—দিনটি বাংলাদেশের ছিল না। এ অবস্থা বেরিয়ে আসায় ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের উন্নতিতে জোর ম্যাকেঞ্জির, ‘পরবর্তী ম্যাচগুলোয় আমাদের ব্যক্তিগত পরিকল্পনাগুলো ঠিকঠাক করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যেন ব্যক্তি হিসেবে ক্রিকেটাররা অনেক বড় অবদান রাখতে পারেন। সাকিব যেমন আজ ওর ইনিংসটি ভালো খেলেছে। আমরা চাই, প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের মধ্যে ৬০/৭০ রানের ইনিংস আসবে। তাহলেই জয়ের মতো রান হয়তো করতে পারতাম।’ ব্যাটসম্যানরা একের পর এক একই ভুলের ফাঁদে পড়ায় কিছুটা হতাশ অবশ্য তিনি, ‘এতগুলো সিরিজ জয়ের কারণে আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। সব ফরম্যাটেই তো ভালো খেলছিলাম। আমরা এখনো ব্যাটসম্যানের সামর্থ্যে বিশ্বাস করি। এটি হতাশার যে, তারা একে অন্যের কাছ থেকে শিখতে পারছে না। দিনটি আসলে আমাদের ছিল না।’
আসলেই দিনটি বাংলাদেশের না। সেই কারণে সিলেট স্টেডিয়ামের রাতের অল্প কিছু বাতিতে অন্ধকার আরো প্রগাঢ় লাগে। মাটি খোঁড়ার যন্ত্রের শব্দে প্রকট হয় নৈঃশব্দ।