রাঙ্গুনিয়ার হোছনাবাদ ইউনিয়নের রেশমবাগান সংলগ্ন পাহাড়ের ঢালুতে কোনো রকমে বসবাস করেন সঙ্গীতা তঞ্চঙ্গ্যার পরিবার। অভাবের সংসার তাঁদের। নানা অভাবের সাথে যুদ্ধ করতে করতে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন সঙ্গীতা।
জুমচাষই তাঁদের একমাত্র অবলম্বন ছিল। জুমচাষ শেষ হওয়ায় পর সংসারে আয়ের আর কোনো পথ থাকে না। জুম চাষের মৌসুম শেষ হলে সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়ে তাঁদের মতো এলাকার অন্যান্য কৃষি পরিবারগুলো। আশপাশের সমতল জমিগুলোতে পুরুষরা করতেন তামাকের চাষ। ওই সময় সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা হয় তাঁদের। এ সময় সঙ্গীতার পরিবারে স্বামী বাপ্পী তঞ্চঙ্গ্যা ও দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে অর্থনৈতিক সংকট লেগেই থাকত। এর ওপর দুই ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগানো ছিল নিত্য দুর্ভোগ। সব মিলিয়ে সংসারে সচ্ছলতা ছিল না।
কারো থেকে কোনো সহায়তা না পেয়ে নিঃস্ব অবস্থায় সংসারে আলোর পথ দেখিয়েছে বেসরকারি এনজিও সংস্থা কারিতাস। কারিতাসের রাঙ্গুনিয়া অফিসের স্থায়িত্বশীল খাদ্য ও জীবিকায়ন নিরাপত্তা প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ নিয়ে সঙ্গীতাসহ পাড়ার নারীরা সবজি চাষে জড়িয়ে পড়েন। সবজি চাষের পাশাপাশি ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরির প্রশিক্ষণ নেন তাঁরা। ২০১৭ সালে অল্প জমিতে বিষমুক্ত সবজি চাষ করলেও পরের বছর অধিক জমিতে সঙ্গীতা নানা জাতের সবজি চাষ করে সফল হন। তাঁদের সবজি চাষে সারের পরিবর্তে ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যবহার করায় সবজিগুলো অধিক স্বাস্থ্যসম্মত বলে বাজারে এর চাহিদাও ব্যাপক। সবজি চাষকে জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে নিয়েই পথ চলতে শুরু করেন সঙ্গীতা। তাঁর বিষমুক্ত উৎপাদিত সবজি এলাকায় চাহিদা পূরণ করে রাঙ্গুনিয়া-কাপ্তাই উপজেলার বিভিন্ন বাজারে বেশ কদর নিয়ে বিক্রি হচ্ছে। এসব বাজারের অনেক বেপারি খুব সকালে তাঁর ঘরের আঙিনায় যায়। এমনকি সবজি নিতে সারাদিন আশেপাশের অনেক মানুষের আনাগোনাতে তাঁর বাড়ির উঠোন যেন সবজি বাজারে রূপ নেয়। সকাল হলেই এলাকার মানুষ টাটকা সবজি কিনতে ভিড় করে তার ও আশপাশের নারীদের ঘরের আঙিনায়। তাঁদের দেখাদেখিতে এলাকার রেশমবাগানের ১৭০ জন উপজাতীয় চাকমা-মার্মা ও তঞ্চঙ্গ্যা পরিবারের অনেকেই সঙ্গীতার মতো সবজি চাষাবাদ শুরু করছে। সবজি চাষে সঙ্গীতার পরিবার এলাকায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সঙ্গীতার সবজি চাষ ভাগ্য বদলে দিয়েছে তাঁর পরিবারের। পরিবারে অভাব এখন নেই বললেই চলে। তাঁদের ছেলে মেয়েরা এখন নিয়মিত স্কুলে যায়। আগে সবজি চাষের এসব জমিতে ব্যাপক তামাক চাষ করতেন উপজাতীয়রা। এখন সবজি চাষ হওয়ায় তামাক চাষ তেমন একটা করেন না তারা। ফলে এলাকার জমিতে মাটির উর্বরতা শক্তিও বাড়ছে।
কারিতাসের সহকারী মাঠ কর্মকর্তা গৌরি ভট্টাচার্য বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে কারিতাসের সুফল প্রকল্প থেকে ৫ রকমের সবজি, বীজ ও সার উৎপাদনের জন্য রিং ও কেঁচো দেওয়া হয়। পাশাপাশি আরো ১৩০ পরিবার এখানে সবজি উৎপাদন করেন। সহজে বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে তঞ্চঙ্গ্যা পাড়ায় সঙ্গীতার বাড়ির উঠানে একটি ছোট কমিউনিটি মার্কেটিং করা হয়। গ্রামের সব নারী পুরুষ এই জায়গায় সবজি নিয়ে আসেন সকালে। এখান থেকে নারী বেপারি নাছিমা আকতারসহ বিভিন্ন নারীরা সবজি নিয়ে যান চন্দ্রঘোনার লিচুবাগান, বরইছড়ি ও কাপ্তাই বাজারে। দুই বছরে সবজি চাষ করে সঙ্গীতাসহ এই পাড়ার নারীরা অনেকটা স্বাবলম্বী। তাদের দেখাদেখিতে এলাকার অনেকে সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেছেন। ফলে এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা অনাবাদি জমিগুলো সবজি চাষ করায় আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। আগে এই জমিগুলোতে ব্যাপকভাবে তামাক চাষাবাদ হত। বর্তমানে কারিতাসের সচেতনতামূলক কার্যক্রমের ফলে সেসব জমিতে তামাক চাষের পরিবর্তে সবজি চাষ হচ্ছে। সঙ্গীতা তঞ্চঙ্গ্যা ও গ্রামের জনগণ এখন স্বপ্ন দেখছেন জুম চাষের পাশাপাশি আঙ্গুর ফল উৎপাদন করবেন। এটি করতে পারলে তঞ্চঙ্গ্যা পাড়ার লোকজনের আর অভাব থাকবে না।’
রেশমবাগান এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘উপজাতীয় নারীদের উৎপাদিত সবজি এলাকায় চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী বাজারে বিক্রি হতে দেখা যায়। অতি সহজে আমরা বিষমুক্ত টাটকা সবজি কিনতে পারি। নারীরা এভাবে এগিয়ে আসলে গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।’
সঙ্গীতা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘প্রতি বাজারে আমি কমপক্ষে আড়াই হাজার টাকার সবজি বিক্রি করি। এ ছাড়া ভার্মি কম্পোস্ট সার বিক্রি করে মাসে আরো ১০-১৫ হাজার টাকা আয় করি। এই আয় থেকে ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালাই এবং পরিবারের আর্থিক চাহিদা পূরণ করে এখন আরো সঞ্চয় করতে পারি। আমার দেখাদেখি এলাকার অন্যান্য আদিবাসী নারীরাও তামাক চাষ বাদ দিয়ে বিষমুক্ত সবজি চাষের দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠছেন।’
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কারিমা আক্তার বলেন, ‘আমরা সব সময় এসব উদ্যোমী নারীদের সহায়তা দিয়ে আসছি। মাঠ পর্যায়ে সার্বক্ষণিক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কাজ করছেন। সঙ্গীতার মতো এলাকার অন্যান্য নারীরাও যদি নিজের অনাবাদি জমি ও বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষাবাদ করেন তবে আমাদের সমাজে বেকারত্ব ও অভাব ঘুচিয়ে দারিদ্র্যতা দূর হবে।’ এ কাজে কৃষি অফিস সার্বক্ষণিক সেবা দিতে প্রস্তুত রয়েছে বলে তিনি জানান।