যাই যাই করছে কাশফুলের হাসিমাখা শরৎ। আসছে শীত। গ্রামবাংলায় প্রস্তুতি পিঠা বানানোর। আর পাহাড়ি কন্যা বান্দরবানের মনোমুগ্ধকর পর্যটন স্পটগুলো হাত বাড়িয়ে আছে পর্যটককে স্বাগত জানাতে।
যাঁরা সবুজ পাহাড়, আকাশের পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘমালা, শীর্ণকায় জলপ্রপাতগুলোর গড়িয়ে পড়া জলরাশির ছোঁয়া নিতে চান-তাঁদের জন্য বান্দরবান ঘুরে বেড়ানোর এটাই ভালো সময়।
না মেঘ-না বৃষ্টি, না শীত-না দাবদাহ, না পিচ্ছিল পথ-না শুষ্ক বালুকাময় মেঠোপথ চলা। মধ্যবিত্তের সাজানো গোছানো জীবনের মতো এক ধরনের মধ্যবর্তী রূপ এখন পাহাড়ের।
কোথাও পাহাড়ের বুক ভরে পাকা পাকা ধানের ক্ষেত। কোথাও পাহাড়ি নারীরা কাটছেন জুমের ধান। জুম ঘর লাগোয়া মাচাংয়ে ধান শুকোচ্ছেন কেউ। বাতাসে উড়িয়ে ধান থেকে ‘চিটা’কে বিদেয় জানাচ্ছেন কেউ কেউ।
কান পাতলেই শোনা যাবে-দূর পাহাড়ে বাজছে রাখালি বাঁশি। ধেনু চরানোর পাশাপাশি নিজের একাকিত্ব মনের বৈরাগ্য বাঁশির সুর উচাটন করে দেবে ছুটে চলা পর্যটক মন। সুরের মূর্ছনায় নিজেকে হারাতে খানিক দাঁড়াতেই হবে আপনাকে।
পাহাড়ের এখানে ওখানে জুম ধানের সোঁদা সোঁদা গন্ধ। কারো কারো ঘরের মাচাংয়ে ধান শুকানোর পালা। কেউ গোলায় তুলেছে জুমের শুকনো ধান। আনন্দে ভাসছে কেউ কেউ। নতুন ধানের পিঠা বা বিন্নি ভাত খাওয়ার প্রস্তুতি কারো কারো ঘরে।
রোদে পোড়া শ্রমের সময় কেটে গেছে এখন।
তাই উন্মন যুবক-যুবতীদের অবিরাম অবসর সময়। দল বেঁধে তারা ঘুরে বেড়ায় পাড়ায় পাড়ায়। জ্যোত্স্না রাতে মাথায় ঝুঁটি বাঁধা ম্রো যুবক যুবতীদের রাত জাগা নিষ্পাপ আড্ডা পাহাড়ের চুড়োয়-চুড়োয়। বম, পাংখো, লুসাই, খুমি, ত্রিপুরা ও খেয়াংপাড়ায় চলছে প্রাক বড়দিনের প্রস্তুতি। মহড়ার ব্যান্ডের মনকাড়া সংগীতও ভেসে আসছে কোনো কোনো গ্রাম থেকে। অক্টোবর-জানুয়ারি প্রান্তিকে যেন আলাদা করে সেজে ওঠে পাহাড়ি জীবন।
বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকাগুলোর মধ্যে চমৎকার স্বাতন্ত্র্যতা মেলে বান্দরবানের জীবনযাত্রায়। এখানে সারি সারি পাহাড় যেমন আছে, তেমনি দেখা মেলে স্রোতস্বিনী পাহাড়ি নদী খালের। দূরে কোথাও ঝরঝর করে পড়ছে জলপ্রপাতের জলরাশি।
নানা রঙের পোশাক, নানা বেশ-ভূষা, নানা বৈচিত্র্যময় পেশা এখানকার মানুষের। বম, ম্রো, খুমিরা ঝুঁকেছে অর্থকরী ফসল উৎপাদনে। তাদের পাহাড়ি জমিতে ফলের বাহার। বাগান থেকে সতেজ-সবুজ ফল নিয়ে রাস্তায় বসেছে উৎপাদকরা। ভেজাল নেই। ফরমালিন নেই। জোর করে পাকানো ফলের ভয়ও নেই এখানে।
আর পাহাড়ের বুক থেকে সোনা ফসল ফলানোতেই দূর পাহাড়ে যাদের বসতি-মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, খেয়াং, তঞ্চঙ্গ্যা জনজাতির বিচরণ। তাদের ঘরে ঘরে হয়তো প্রাচুর্য নেই। কিন্তু প্রাণভরা সুখ ও ভালোবাসায় এক স্বপ্নময় জীবন গড়ে তুলেছেন সেসব পাহাড়বাসী।
তাই এমন সময়টাই পাহাড় এবং পাহাড়ি জীবন দেখার আদর্শ সময়।
এই সময়টাতে সহজে চলে যাওয়া যাবে বগালেক, কেওক্রাডং, তাজিনডং, বড় মোদক, ছোট মোদক, লামার মিরিঞ্জা পাহাড়, আলীকদমের গিরি পাহাড়ের এখানে ওখানে ঝরঝর বয়ে যাওয়া জলপ্রপাতের ঠাণ্ডা জলে নাইয়ে নেয়া, মাতামুহুরী নদীতে ভেসে ভেসে কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী এলাকা ঘুরে দেখা।
শঙ্খের স্রোত কিছুটা হয়তো কমে গেছে, শুকিয়ে তলানির কাছে পৌঁছেছে পাহাড় থেকে নেমে আসা জলধারা। তবু থানচিতে গিয়ে নৌকোয় চড়ে পানিতে ডুবে থাকা বড় বড় পাথরের তিন্দু। রেমাক্রি জলপ্রপাতের ছুটে চলার দৃশ্য দেখা যাবে এখনো।
ছিপছিপে নৌকোয় বসে ‘হাওয়াই ফাইভ ও’ ছবির মতো জলের ঘূর্ণন অনুভব করা যাবে তিন্দু রেমাক্রির মাঝামাঝি জায়গাটিতে।
আর বগালেক যাবার রাস্তাতো এখন সুনসান। গাড়িতে চড়ে কিংবা মোটরবাইক নিয়ে সোজা চলে যাওয়া যাবে বগালেক। বগালেকের নীল জলে সাঁতার কাটতে এ সময়টা সব বয়সী মানুষের জন্যে ভীষণ উপযোগী।
এ ছাড়া যে কেউ চাইলে এ সময়টাতে চলে যেতে পারেন রোয়াংছড়ি উপজেলার কচ্ছপতলী শীলবান্ধা ঝর্নায়। চিংড়ি ঝর্না, জাদিপাই ঝর্না, নাফাকুম যাওয়াও এখন খুব একটা কষ্টকর নয়।
ইচ্ছা করলে মাত্র ১৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চলে যেতে পারেন বান্দরবান-থানচি সড়কের ওয়াই জংশন সংলগ্ন সাইরু রিসোর্টে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আপনি দেখে আসতে পারেন প্রায় দুই হাজার ফুট উঁচুতে নির্মাণ করা চমৎকার সুইমিং পুলটিও।
বান্দরবান বেড়াতে এসে থাকা-খাওয়া নিয়ে খুব একটা ভাবার দরকার নেই। এখানে বিলাসবহুল হোটেল রিসোর্ট যেমন আছে, তেমনি আছে অনেক সাশ্রয়ী হোটেলও।
আর বগালেক, ক্রেওক্রাডং বা আরো কিছু এলাকায় গেলে আপনি পাহাড়িদের পরিচালিত ট্রেডিশনাল রিসোর্টেও থাকতে পারেন।
দল বেঁধে গেলে খরচ খুব একটা পড়ে না। থাকা খাওয়া মাথাপিছু বড়জোর ৪০০ টাকা খরচ করে আপনি এসব রিসোর্টে একটি দিন আনন্দে কাটিয়ে আসতে পারেন।