দেশি-বিদেশি গবেষকদের সমন্বয়ে পাট ও মহিষের জীবনরহস্য উন্মোচিত হয়েছে। যে কোনো প্রজাতির জীবনরহস্য উদ্ভাবন অনেক ব্যয়সাধ্য। তবু কিছু করার অভিপ্রায়ে দিনরাত নিজেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বিশ্বে প্রথমবারের মতো ইলিশের জীবনরহস্য উন্মোচন করা হয়েছে।
ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ড. মো শামসুল আলমের নেতৃত্বে বিশ্বে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের জীবনরহস্য (পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং) সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।
এখন প্রশ্ন এসে যায়- এই আবিষ্কারের ফলে জাতি কীভাবে উপকৃত হবে বা এর ফল প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছাবে কিনা। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন গবেষক দল।
আবিষ্কারের ফল সম্পর্কে প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. মো. শামসুল আলম বলেন, আমরা ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছি। জিনোম সিকোয়েন্সিং হচ্ছে- কোনো জীবের জিনোমে সব জৈব অণুসমূহ কীভাবে সাজানো তা জানা। জিনোম হচ্ছে- একটি জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।
এ তথ্য ব্যবহার করে পরে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গবেষণা করে ইলিশের সামগ্রিক উন্নয়ন করতে পারব। এটি একটি দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এ জন্য আরও গবেষণা করতে হবে। ইলিশের জীবনরহস্য পুরোটাই আমরা নিজেরা করেছি, কোনো বিদেশি গবেষকের সহায়তা ছাড়াই।
তিনি বলেন, পরে এ নিয়ে আরও কাজ করতে সহজ হবে, যা অন্য প্রজাতির ক্ষেত্রে কম সুযোগ ছিল। ফলে ইলিশের জীবনরহস্য উন্মোচনের সুফল জাতি পাবে। এখন ইলিশের ব্যাপারে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়, গবেষণা করে ইলিশের জিনকে প্রয়োজনে পরিবর্তন করে চাষ উপযোগীসহ কাঙ্ক্ষিত সবল পরিবর্তনই করা সম্ভব।
গবেষক দলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন- পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বজলুর রহমান মোল্যা, বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল ইসলাম ও ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহা. গোলাম কাদের খান।
এ সাফল্য একদিনে আসেনি। মূল প্রজেক্ট পরিকল্পনা ও প্রস্তুতকরণ শুরু করেন ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। এর পর অনেক ধাপ পেরিয়ে তথ্যগুলো জমা দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যুক্তরাষ্টভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের (এনসিবিআই) তথ্যভাণ্ডার থেকে ২৫ আগস্ট ২০১৭ স্বীকৃতি পায়।
এ ছাড়া ২০১৭ সালের ২৯-৩০ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন ও ২০১৮ সালের ১৩-১৮ জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালির্ফোনিয়ায় অনুষ্ঠিত ২৬তম প্লান্ট অ্যান্ড অ্যানিমেল জিনোম আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গবেষণার বিষয় উপস্থাপন করা হয়। ধারাবাহিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই জাতির সামনে গবেষণা কার্যক্রম উন্মোচন করল গবেষক দল।
সহযোগী গবেষক অধ্যাপক ড. মো. বজলুর রহমান মোল্যা বলেন, ইলিশের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন প্রজননের সময় সাগর থেকে নদীতে আসে। ডিম ছাড়ার পর মা ইলিশ সাগরে ফিরে যায়। ইলিশের রয়েছে স্বতন্ত্র স্বাদ। এদের জীবনচক্রে স্বাদুপানি ও লবণপানি প্রয়োজন হয়। এসব বৈশিষ্ট্যের জন্য কোন জিন দায়ী গবেষণা করে তা জানা সম্ভব।
তিনি বলেন, যখন আমরা এ বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণ জানতে পারব, তখন আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব এবং আমাদের উপযোগী করতে পারব। গবেষণা করে দায়ী জিনগুলোকে শনাক্ত করতে পারলে এগুলো পুকুরে বা স্বাদুপানিতে চাষযোগ্য কিনা বা প্রতিবন্ধকতার সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে পারব।
সহযোগী গবেষক অধ্যাপক ড. মুহা. গোলাম কাদের খান বলেন, এ আবিষ্কারের ফলে বাংলাদেশি ইলিশের একটি আদর্শ জিনোম তৈরি হল। পরে অন্য কোনো স্থানের ইলিশ নিয়ে গবেষণা করলে এ আদর্শকে ব্যবহার করে তুলনা করা যাবে। ইলিশের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও আহরণমাত্রা নির্ণয়ের জন্যও এ গবেষণা সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. গিয়াসউদ্দিন আহমদ বলেন, ইলিশের জীবনরহস্য উন্মোচন আমাদের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ, বিশ্ববিদ্যালয় তথা দেশের জন্য একটি বড় অর্জন। এটি একটি যুগোপযোগী আবিষ্কার, যা পৃথিবীতে মাইলফলক হয়ে থাকবে। এখন এ তথ্য ব্যবহার করে অন্যান্য গবেষক আরও বৃহৎপরিসরে কাজ করতে পারবে, আরও নতুন নতুন তথ্য উন্মোচন করতে পারবে।
এর সুফল সম্পর্কে বলেন, সুফল বলে শেষ করা যাবে না। এ তথ্যকে কাজে লাগিয়ে আমরা ইলিশের প্রকৃত প্রজননকাল নির্ণয়, উৎপাদন কম হচ্ছে কেন তা জানা, জলবায়ু পরিবর্তনে এর প্রভাব ও করণীয় কী এ সম্পর্কে জানা, এদের খাবার সম্পর্কে সম্যক ধারণা এবং স্বাদের কারণ- এমন অনেক কিছুই জানা সম্ভব হবে। মোটকথা- ইলিশ সম্পর্কে জানার দরজা খুলে গেল এবং ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জীবন উন্মুক্ত হল।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ইলিশের জীবনরহস্য উদ্ঘাটনের তথ্য থেকে শুরু করে ইলিশ সাগর থেকে নদীতে আসা ও যাওয়ার কারণ, পৃথিবীতে ইলিশের কতগুলো বাসস্থান (স্টক) আছে এবং ইলিশের প্রজননব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যাবে। এ গবেষণাকে মাঠপর্যায়ে ব্যবহার করতে পারলে ইলিশের উৎপাদন বাড়বে, সেই সঙ্গে সবাই উপকৃত হবে।