Monday , 1 July 2024
সংবাদ শিরোনাম

কন্যা সন্তানকে পুত্র সন্তানের মতই বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে -ইসলাম

 পৃথিবীর বহু মনীষী, বীরযোদ্ধা, বৈজ্ঞানিক, কবি-সাহিত্যিক তাদের নিজ নিজ কর্মে উৎকর্ষ সাধনের পেছনে তাদের স্ত্রীদের অবদান অকপটে স্বীকার করেছেন। এমনকি নারীর সঠিক মূল্যায়ন না করে তাদেরকে যারা ভোগের পণ্য বানিয়েছে, তারাও আজ বহু দেশে নারীর অধীনে কাজ করছেন। রাষ্ট্রীয় দূতিয়ালী থেকে নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের জটিল কাজগুলোও আজ নারীরা করছে। আজ নারীরা পুরুষের সাথে সকল কাজে অংশগ্রহণ করে প্রমাণ করছে তারা কোন অংশে বা কোন ব্যাপারে পুরুষের থেকে পিছিয়ে নেই। আবার তথাকথিত সভ্যদেশে নারীকে পিতামাতার উত্তরাধিকার পর্যন্ত দেয়া হয়নি। বিশ্বনবী (সা.) নারীদেরকে মর্যাদা দিতে যে ব্যবস্থা শিখিয়েছেন তার কারণে তৎকালীন নারী সমাজ যে কোন উন্নত অবস্থা থেকে বেশি মর্যাদা লাভে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনিই মায়ের অধিকার পিতা থেকে তিনগুণ বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং পুরুষের সাথে সর্ব পর্যায়ে মীরাসের অধিকারী বলে জানিয়েছেন। ছেলের তুলনায় কন্যা পাবে অর্ধেক একথা বলে যারা ইসলাম নারীকে ঠকিয়েছে বলে থাকেন তারা হিসেব করেন না পিতা-মাতার পরিচর্যা কন্যার উপরে নয়, পুত্রের উপর। সংসার পরিচালনার দায়িত্ব স্ত্রীর নয়, পুুরুষের। আল্লাহ তাআলা বলেন, “পুরুষগণ নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল, পরিচালক, অভিভাবক।” “আল-কোরআন, ৪ : ৩৪।” কোরআন মাজিদ ঘোষণা করে যে, জীবনের সব রকমের সংগ্রাম সাধনা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি নির্মাণে এবং উত্থান-পতনের ক্ষেত্রে সর্বদাই নারী ও পুরুষ পরস্পরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে। জীবনের দুর্বিষহ বোঝা উভয়েই বহন করেছে। উভয়ের ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত চেষ্টা-প্রচেষ্টার ফলেই সমাজ, সভ্যতা ও তমদ্দুনের ক্রমবিকাশ ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা, প্রচার ও প্রসারে সর্বকালের নারী ও পুরুষের যৌথ চেষ্টা ও তৎপরতার কাহিনী বিশ্ব ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। দুনিয়ার কোন জাতিই নারী-পুরুষ কাউকে উপেক্ষা করতে পারে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন- “মুমিন নর ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভাল কাজের নির্দেশ দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে, তারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আনুগত্য করে আল্লাহ ও তার রাসূলের। এদের উপর আল্লাহ রহমত বর্ষণ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ প্রবল প্রতাপশালী, হিকমতওয়ালা।” “আল-কোরআন, ৯ : ৭১।” ন্যায় সত্য প্রতিষ্ঠার সময় নারী ও পুরুষ যেমন পাশাপাশি থেকে একে অপরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করে, ঠিক তেমনি বাতিল নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও সমানভাবে তারা অংশীদার হয়ে থাকে। এতে বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম দেখা যায় না। এই শ্রেণির লোকদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন- “মুনাফিক নর এবং মুনাফিক নারী একে অপরের ন্যায়। তারা মন্দ কাজের নির্দেশ দেয় এবং ভাল কাজ থেকে বারণ করে, তারা বন্ধ করে রাখে নিজেদের হাত। তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, তাই তিনিও তাদের ভুলে গেছেন। নিশ্চয় মুনাফিকরাই হল ফাসিক।” “আল-কোরআন, ৯ : ৬৭।” জাহিলী যুগে আরব সমাজে কন্যারূপে নারীর বড়ই অমর্যাদা ছিল। কন্যা সন্তানকে জঘন্যভাবে ঘৃণা করা হতো। তাকে জীবিত কবর দেয়া হতো। স্বয়ং পিতা কন্যা সন্তানের জন্মকে চরম অপমানজনক মনে করতো। কোরআন মাজিদে কন্যা শিশুর অপমানের চিত্র এভাবে অংকন করা হয়েছে-“আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ প্রদান করা হয়, তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং মনের মধ্যে ক্রোধ চেপে রাখে। তাকে যে সুসংবাদ দেয়া হল তার লজ্জায় সে নিজের লোকদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায়; সে ভাবে অপমান সহ্য করেও তাকে জীবিত রেখে দেবে, না কি মাটির নিচে পুঁতে ফেলবে? জেনে রেখো, কত নিকৃষ্ট তাদের সিদ্ধান্ত!” “আল-কোরআন, ১৬ : ৫৮৫৯।” ইসলাম মানবতাবিরোধী এ কাজকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কন্যা সন্তানকে পুত্র সন্তানের মতই বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে। শুধু তাই নয়, কন্যা সন্তানকে জীবিত প্রোথিত করলে কিয়ামতের দিন যে তার পিতাকে আল্লাহর দরবারে কঠোরভাবে জবাবদিহি করতে হবে, তাও কোরআন মাজীদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলাম কন্যাসন্তানদের এ অপমান দূর করে তাদেরকে পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দান করেছে। মৌলিক অধিকারে তাদেরকে পুরুষদের সমান অংশীদার করা হয়েছে। জাহেলীযুগে আরব সামজে নারী সামজ বড়ই অসহায় ছিল। স্বামীর সম্পদে তার কোন অধিকার ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পত্তিতেও স্ত্রী কোন অংশ পেত না। বিধবা নারীদের এই অসহায় অবস্থা দূর করার জন্য কোরআন ঘোষণা দিল-“তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ পাবে যদি তোমাদের সন্তান না থাকে। তবে তোমাদের সন্তান থাকলে তারা পাবে তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পদের আট ভাগের এক অংশ।” “আল- কোরআন, ৪ : ১২।” ইসলাম মা হিসেবে নারীকে যে সম্মান দান করেছে পৃথিবীর আর কোন সম্মানের সাথে তুলনা হয় না। পিতা ও মাতা উভয়ের প্রতি সাধারণভাবে সম্মান প্রদর্শনের কথা উল্লেক করার পর কোরআনে মাতার প্রতি বিশেষ ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেননা মা সন্তানকে গর্ভে ধারণ করা, প্রসব করা এবং স্তন্য দান করার কষ্ট একাকী বহন করে থাকেন। এ তিন পর্যায়ের ক্লেশ ও যাতনায় পিতার কোন অংশ নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-“আর আমি মানুষকে তার মাতা-পিতা সম্বন্ধে নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে এবং দু’বছরে তার দুধ ছাড়ানো হয়। সুতরাং শোকরগুজার হও আমার এবং তোমার পিতা-মাতার। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে।” “আল-কোরআন, ৩১ : ১৪।” মহান আল্লাহ বলেন- “আর তোমার রব আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। যদি তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধ্যক্যে উপনীত হয়, তবে তুমি তাদেরকে ‘উহ’ পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; তাদের সাথে বিনম্রভাবে সম্মানসূচক কথা বলো। এবং তাদের সামনে ভক্তি শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সাথে অবনত থেক, আর প্রার্থনা কর: হে আমার রব! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করুন, যেভাবে তাঁরা আমাকে শৈশবে লালন পালন করেছেন।” “আল-কোরআন, ১৭ : ২৩-২৪।” সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখার জন্য যখন উভয়ের প্রয়োজন একই রকম, তখন তাদের মধ্যে তারতম্য করা নিতান্তই অযৌক্তিক। ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানরা আল্লাহ তাআলার কিতাবকে বিকৃত বা পরিবর্তন করে কিছু লোকের বা পুরুষ শ্রেণির সুবিধাকে নিশ্চিত করার জন্য নারীদেরকে দুর্লক্ষণে বলে অভিহিত করে। তারা নারীদেরকে প্ররোচনা দানকারী প্রমাণ করার জন্য তাদের কিতাবগুলোর আয়াত পরিবর্তন করে প্রচার করেছে- আদম (আ.)কে মা হাওয়া (আ.) নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ানোর কারণে আজ আমাদের পৃথিবীতে আগমন, না হলে আমরা চিরদিন বেহেশতেই থাকতাম। অথচ আল কোরআনে বলা হয়েছে-“এরপর শয়তান তাদের দু’জনকেই সেই নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার জন্য প্ররোচিত করল, তারপর তাদের দু’জনকে বের করে ছাড়ল সেখান থেকে যেখানে তারা ছিল।” “আল-কোরআন, ২ : ৩২।” আজকের পৃথিবী নারীদের দেহকে যেভাবে ভোগ ও পণ্যসামগ্রী বানিয়ে রেখেছে, অতীতেও একইভাবে তাদেরকে হীন-কুচক্রী আখ্যা দিয়ে শুধু ভোগ্য ও পণ্য বানিয়ে রেখেছিল। জাহিলীযুগে মানুষ কন্যাসন্তান জন্মকে অশুভ বলে মনে করতো। আর এ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জন্ম হওয়ার সাথে সাথে কন্যাসন্তান হত্যা করার রীতি চালু করা হয়। অথচ পুরুষ ও নারীশিশু আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাতে জন্মগ্রহণ করে। আজও যারা নানা অজুহাতে এই হত্যাকা-ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে তারা জঘন্য অপরাধ করছে, তাদের ধারণায় যে সব কারণে কন্যাশিশুদেরকে জন্ম লগ্নেই হত্যা করা হতো, সে সব কারণ নিম্নে চিহ্নিত করা হল- (১) কন্যাসন্তানদেরকে বিয়ে দিতে গিয়ে অপরের কাছে ছোট হয়ে যেতে হয় এবং কন্যার নিরাপত্তার জন্য বরপক্ষকে বরাবরই তোয়াজ করতে হয়। আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ এটা সহ্য করতে চাইত না। (২) পৃথিবীতে মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে গেলে অবশ্যই যুদ্ধ বিগ্রহ করে বীরত্বের পরিচয় দিতে হয়। এজন্য প্রয়োজন শক্তিশালী যোদ্ধা সন্তান। কন্যাসন্তানদের নিকট থেকে এ বীরত্ব আশা করা যায় না। বরং তাদের উপস্থিতি ও নিরাপত্তার চিন্তার কারণে ঝামেলামুক্তভাবে লাড়াই করাও সম্ভব হয় না। এজন্যই জন্মলগ্নেই তাদেরকে হত্যা করা প্রয়োজন মনে করতো।

Copyright Daily Inqilab

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top