পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে তিনিও বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষক। কিন্তু তিনি কখনও এ ঘোষণার জন্য রাষ্ট্র বা সমাজের কাছে কোন প্রকার সম্মান বা মর্যাদা দাবী করেননি।
১৯৭১ খ্রিঃ এপ্রিলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ১৯৭২ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত হলে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উক্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি উচ্চতর গণিতসহ কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। অতঃপর তিনি টাঙ্গাইলের বাগবাড়ী চৌবাড়ীয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে প্রায় ১ বছর ৬ মাস শিক্ষকতা করেন।
১৯৭২ খ্রিঃ তিনি তাঁর নিজ গ্রাম টাঙ্গাইল সদর থানার খরশিলায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি উক্ত বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এসময় তিনি মাওলানা ভাসানীর সাথে ঘনিষ্ট হয়ে উঠেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী)-র রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে পড়েন। একই বছর তাঁর ছোট ভাই লেবু ও বোন শান্তি কলেরায় আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় তাঁরই চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করে। তিনি এখনও সেই ভয়াবহ স্মৃতি বহন করে চলেছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ খ্রিঃ ১০ জানুয়ারী শেখ মুজিব স্ব-গৌরবে ফিরে আসেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আপন জনগণের কাছে; সঙ্গে ছিলেন ড. কামাল হোসেন। শেখ মুজিব ১১ জানুয়ারী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারী করেন। সংবিধান রচনার পূর্ব পর্যন্ত এই অস্থায়ী সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালিত হতে থাকে। সংবিধান রচনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৭২ খ্রিঃ ২৩ মার্চ রাষ্ট্রপতি এক গণপরিষদ আদেশ জারী করেন। এ আদেশ ১৯৭১ খ্রিঃ ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে ধরা হয়। এ আদেশ অনুসারে ১৯৭০ খ্রিঃ ৭ ডিসেম্বর হতে ১৯৭১ খ্রিঃ ১০ জানুয়ারী পর্যন্ত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসনসমূহে বাংলাদেশ হতে নির্বাচিত সকল গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদ গঠিত হয়। ১৯৭২ খ্রিঃ ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বর্তমানে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে চৌত্রিশ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। আইন মন্ত্রী ছাড়াও এ কমিটিতে আরও চারজন মন্ত্রীকে নেয়া হয়। তারা হলেন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও জনাব এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান। এ কমিটি কর্তৃক উপস্থাপিত খসড়া সংবিধান পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর ৪ নভেম্বর পরিষদ সদস্যদের তুমূল হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্য দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে চুড়ান্তভাবে গৃহীত হয়।
অন্যদিকে শোষণহীন তথা সমাজবাদী অর্থনীতি ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৯৭২ খ্রিঃ ২৬ মার্চ শেখ মুজিব ও তার সরকার বাংলাদেশের প্রচলিত তফসীলভূক্ত ব্যাংক, বীমা, বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহকে জাতীয়করণ করেন যদিও তাঁর দলের বৃহৎ অংশ বুর্জোয়া অর্থনৈতিক আদর্শে গড়ে উঠেছিলেন। বস্তুতঃ বুর্জোয়া অর্থনীতিতে গড়ে উঠা প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় তাঁর ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্থাৎ শোষণমুক্ত সমাজ গঠন অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়।
স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ মুজিববাদের চার অন্যতম সংগঠকের মধ্যে মার্কসবাদে বিশ্বাসী সিরাজুল আলম খান ১৯৭২ খ্রিঃ প্রথমার্ধে শেখ মুজিবকে রাজনৈতিক দলসহ পার্লামেন্ট বাতিল করে বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে সমাজতান্ত্রিক নীতি প্রণয়ন করার জন্য পরামর্শ দেন। শেখ মুজিব তাতে রাজী না হওয়ায় সিরাজুল আলম খান ১৯৭২ খ্রিঃ ৩১ অক্টোবর মেজর (অবঃ) এম.এ জলিলকে সভাপতি, আ.স.ম আবদুর রবকে মহাসচিব ও স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক শাজাহান সিরাজকে সহ-সভাপতি করে ছাত্রলীগের ভিন্ন মতাবলম্বী অংশের সমন্বয়ে গঠন করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)।
এখানে উল্লেখ্য যে, মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু-র শিক্ষকতাকালীন টাঙ্গাইল জেলা শিক্ষা অফিসার ও তাঁর নিজ গ্রামের বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা আবু হাছান মাষ্টার (মোঃ হাছেন আলী) এর পরামর্শে শিক্ষকতা বাদ দিয়ে ১৯৭৩ খ্রিঃ প্রথমার্ধে মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষে ভর্তি হন। একই বছর ৭ মার্চ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনী এলাকা- ১৩৭, টাঙ্গাইল-৫, টাঙ্গাইল সদর- দেলদুয়ার আসনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সিনিয়র সহ-সভাপতি ড. আলীম আল রাজীর পক্ষে পশ্চিম টাঙ্গাইলে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নেতৃত্ব দেন।
১৯৭৩ খ্রিঃ তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকসু (ঊটঈঝট) নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে সোহরাওয়ার্দী হল সংসদে সহকারী সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন এবং বিজয়ী হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালীন পুরো সময়ে তিনি এ পদে বহাল থাকেন। এ সময়ে তিনি মেজর জলিলের সান্নিধ্যে আসেন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন।
এদিকে ১৯৭৩ খ্রিঃ মুজিব সরকার যে রাষ্ট্রপতি আদেশ নং- ৯ প্রবর্তন করে তাতে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠনে চাকুরীজীবিদের অনীহা দেখা দেয়। কারণঃ উক্ত আদেশে সরকারী কাজে নিয়োজিত যে কোন কর্মকর্তাকে আত্মপক্ষ সমর্থন ব্যতিরেকেই চাকুরী থেকে বিনা নোটিশে বরখাস্ত করার বিধান প্রবর্তিত হয়েছিল। এ আইন দেশকে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়।
১৯৭৪ খ্রিঃ ১৭ মার্চ জাসদ জনসভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও ও স্মারকলিপি পেশ করার কর্মসূচি নেয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওকালে রক্ষী বাহিনীর ব্রাসফায়ারে ঘটনাস্থলেই চারজন নিহত এবং বহু ছাত্রলীগ ও জাসদ কর্মী আহত হয়। স্বয়ং আ.স.ম আবদুর রবও গুলিবিদ্ধ হন। এহেন অবস্থায় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা নিয়ে সংগঠনসমূহ গড়ে উঠার যে প্রক্রিয়া শুরু হলো তারই পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদ ও সমরবাদ জন্ম নিল। বস্তুতঃ ১৯৭৪ খ্রিঃ মাঝামাঝি থেকে জাসদ রাজনীতি কার্যতঃ নিষিদ্ধ হয়ে গেল। একটি প্রকাশ্য বিকল্প গণসংগঠন এমনভাবে বিলুপ্ত হওয়ায় পার্টির কর্মী সমর্থকরা এক অনিশ্চিত অবস্থায় নিপতিত হন। কিন্তু নেপথ্য কণ্ঠ থেকে ভেসে এলো এক বিপ্লবী অনুপ্রেরণার মন্ত্র। “দেশে এখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, এখানে সংগ্রাম অর্থ যুদ্ধ আর সংগঠন মানে সেনাবাহিনী। এ শ্লোগানের রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করলো ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’।” জাসদ কর্তৃক তারুন্য নেতৃত্বে গঠিত বিপ্লবী গণবাহিনীর দূর্বার আন্দোলনের মুখে শেখ মুজিব সরকারকে হিমসিম খেতে হয়। অপরপক্ষে স্বাধীনতাত্তোর সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকান্ড বাঙ্গালী জাতীয় জীবনে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এহেন পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব গঠিত রক্ষী বাহিনীকে গণবাহিনী ও সর্বহারা পার্টি দমনে নিয়োজিত করা হয়। অপরদিকে ১৯৭৪ খ্রিঃ দেশে ভয়াবহ বন্যার ফলে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ এক চরম দুর্দশার মধ্যে পতিত হয়। দূর্ভিক্ষে অনাহারে বেশ কিছু লোক মারা যায়। তৎকালীন সরকার রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ব্যবস্থা না নিয়ে শুধুমাত্র দমননীতির মাধ্যমে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে রক্ষী বাহিনী নিয়োগ করে। ফলে রক্ষী বাহিনীর মাত্রাধিক্য দমনমূলক কার্যকলাপে বহু তরুন-জীবন অকালে হারিয়ে যায়। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিপ্লবী নেতা সিরাজ সিকদারকে ১৯৭৫ খ্রিঃ ২ জানুয়ারী শেখ মুজিবের শাসনামলে রক্ষী বাহিনীর হেফাজতে অকালে জীবন দিতে হয় যা জাতির জন্য খুবই লজ্জাজনক। অপরদিকে মুজিব সরকারের দুর্নীতিপরায়ণ অংশের ব্যাপক দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অসামাজিক কার্যকলাপ দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এতদ্ব্যতীত সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত যুদ্ধ বিধস্ত বাংলাদেশ তখনও বিশ্ব-রাজনীতির দাবানলে পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রের সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগে ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। এমন তিক্ত পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব ১৯৭৫ খ্রিঃ ২৫ জানুয়ারী সম্ভবতঃ শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় সংসদের সর্বশেষ অধিবেশনে বাংলাদেশ সংবিধান (৪র্থ সংশোধনী) আইন’ ৭৫ পাস করে বহুদলীয় রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা রহিত করে আওয়ামী লীগ বাতিল করতঃ এক দলীয় বাকশাল পদ্ধতির প্রবর্তন করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামল, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের মাত্র ছয় মাস শাসনামল এবং বাকশাল পদ্ধতি প্রয়োগের প্রস্তুতি নিতে না নিতেই বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী বুর্জোয়া অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ধনিক শ্রেণীর দোসর, আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেপথ্য পরিচালনায় লেঃ কঃ ফারুক রহমান ও লেঃ কঃ খন্দকার আবদুর রশিদ এর নেতৃত্বে পরিচালিত সামরিক বাহিনীর একটি অংশ (দু’টি ইউনিট একটি ট্যাংক রেজিমেন্ট যার সরাসরি নেতৃত্বে ছিলেন কর্ণেল ফারুক অন্যটি আর্টিলারী যার সরাসরি নেতৃত্বে ছিলেন কর্ণেল রশিদ) ১৯৭৫ খ্রিঃ ১৫ আগষ্ট ভোর রাতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এখানেই শেখ মুজিবের সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটে।
৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ভোর রাতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মদ, ক্যাপ্টেন (অবঃ) মনসুর আলী ও এইচ.এম. কামরুজ্জামানকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দী সেলে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। গৃহবন্দী সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের অনুরোধে কর্ণেল (অবঃ) তাহেরের নেতৃত্বে জাসদ কর্তৃক গঠিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ ভোর রাতে খালেদ মোশাররফের পতন ঘটায়। জিয়া মুক্তি লাভ করেন। শোনা যায় জিয়ার নির্দেশে জিয়ার সমর্থকরা বন্দী অবস্থায় ৭ নভেম্বর সকালে জেনারেল খালেদ মোশারফ, কর্ণেল হুদা ও কর্ণেল হায়দারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
১৯৭৫ খ্রিঃ ১৫ আগষ্টের পট- পরিবর্তনকে জাসদ মেনে নেয়নি। জাসদ মনে করে এ পট পরিবর্তনে দেশের কাঠামোগত বা উপকাঠামোগত কোন পরিবর্তন হয়নি। ফলে জাসদ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের এ অবস্থান থেকে ঐ পরিবর্তনের বিরোধিতা করে।