বাবা-মাকে হত্যার দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মেয়ে ঐশী খালাস চেয়ে আপিল করেছেন। রোববার তার আইনজীবীর মাধ্যমে হাইকোর্টে তিনি এ আবেদন করেন।গত ১২ নভেম্বর ঐশীর ফাঁসির দণ্ড দেন আদালত। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক সাঈদ আহমেদ জনাকীর্ণ আদালতে এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার আগে কারাগার থেকে ঐশী এবং তার বন্ধু রনিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।চাঞ্চল্যকর এ মামলায় ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে দু’বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। দণ্ডের অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আরেক আসামি আসাদুজ্জামান জনিকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।বাবা পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও মা স্বপ্না রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে প্রধান আসামি হিসেবে মেয়ে ঐশী রহমানকে ‘ডাবল’ মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। প্রথমে মা ও পরে বাবাকে পরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার দায়ে দ্রুত বিচার আদালত এই ডাবল মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। এই দণ্ডের পাশাপাশি বিশ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ডও দেয়া হয় তাকে। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ঐশীকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর মালিবাগের চামেলীবাগে নিজেদের বাসা থেকে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে রমনা থানায় আত্মসমর্পণ করেন এ দম্পতির বড় মেয়ে ঐশী। পরে ঐশীর কথা অনুযায়ী গ্রেফতার করা হয় তার বন্ধু রনি ও জনিকে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী জানায়, তার এই দুই বন্ধু রনি ও জনিকে নিয়েই সে তার বাবা-মাকে খুন করেছে। পরে ঐশী ও সুমি নৃশংস এই খুনের বীভৎস বর্ণনা দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।রায়ের পর্যবেক্ষণ ও আদেশে বলা হয়, হত্যাকাণ্ডটি ছিল পরিকল্পিত ও নৃশংস। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দেখা গেছে, ঘটনার সময় ঐশী প্রাপ্তবয়স্ক ছিল। হত্যার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় এবং নৃশংসতা বিবেচনায় নিয়ে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ঐশীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হল। মাকে কফি খাইয়ে অজ্ঞান করে হত্যার দায়ে ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বাবাকে হত্যার অভিযোগে পৃথকভাবে একই দণ্ড দেয়া হল। রায়ের পর্যালোচনায় বিচারক বলেন, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ঠাণ্ডা মাথায় জোড়া খুন করা হয়েছে। হঠাৎ উত্তেজনার ফলে এমন ঘটনা ঘটেনি। খুনের সময় সে সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিল। আসামিপক্ষ তাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক বললেও তা প্রমাণ করতে পারেনি। সে মাদকাসক্ত হলেও বাবা-মাকে সে হত্যা করেছিল সুস্থ মস্তিষ্কে।বিচারক বলেন, আমার ধারণা ওনার (ঐশী) মাকে হত্যার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু মাকে খুন করে বাঁচতে পারবেন না চিন্তা করেই তিনি বাবাকে খুন করেন। এটি একটি নির্মম হৃদয়বিদারক ও জঘন্য ঘটনা। তাই সর্বোচ্চ সাজা দেয়া হয়েছে। রায় লেখার আগে সামাজিক চিন্তা ছাড়াও নানান বিষয় চিন্তা করেছি। বিচারক বলেন, একজন শিশুর বিরুদ্ধে এমন রায় দেয়ায় আপনারা হয়তো বা সমালোচনা করবেন। আমি ভেবে দেখেছি যেহেতু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত। আর আসামির বয়স যা-ই হোক না কেন, তার সর্বোচ্চ শাস্তিই পাওয়া উচিত।চলতি বছরের ২০ অক্টোবর ও ৪ নভেম্বর রাষ্ট্র ও আসামির পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন সম্পন্ন হয়। ১৩ অক্টোবর মামলার প্রধান আসামি ঐশীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেন আদালত। সে সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করে লিখিত বক্তব্য দাখিল করেন ঐশী। অপর দুই আসামি জনি ও রনিও নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার চান। এর আগে মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত ৫৭ জনের মধ্যে ৩৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।২০১৪ সালের ৯ মার্চ ডিবির ইন্সপেক্টর মো. আবুয়াল খায়ের মাতুব্বর এ মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পরে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য গ্রহণের মাঝপথে চার্জশিটে ত্রুটি ধরা পড়ে। সরকারি কৌঁসুলি ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনার পর গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়। এ অভিযোগপত্রে নতুন করে ঐশীসহ চারজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণকারী হাকিম এবং সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখিত দু’জনসহ ৭ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রথমবার দাখিলকৃত অভিযোগপত্রের ৮ জন সাক্ষীকে বাদ দেয়া হয়।গত বছরের ২৪ আগস্ট এ মামলায় ঐশী ও তাদের গৃহকর্মী খাদিজা আক্তার সুমি (১১) ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় হাকিমের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।গত বছরের ৬ মে ঐশীসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন মহানগর দায়রা জজ আদালত। পরে মামলাটি ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। গত বছরের ৩০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন বিচারক এবিএম সাজেদুর রহমান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করেন।ওই হত্যাকাণ্ডের পরদিন মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই মো. মশিউর রহমান রুবেল রাজধানীর পল্টন থানায় এ হত্যা মামলা করেছিলেন। তবে এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ঐশী তার বাবা-মাকে খুনে করেছে বলে তিনি মনে করেন না।এদিকে এ মামলার অন্য আসামি ঐশীদের বাসার শিশু গৃহকর্মী খাদিজা আক্তার সুমি অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তার বিচার চলছে শিশু আদালতে। গত বছরের ২০ মে সুমির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে তাকে জামিন দেন শিশু আদালতের বিচারক জাকিয়া পারভিন।গত বছরের ১ জুন গাজীপুরের কিশোর সংশোধন কেন্দ্র থেকে মা সালমা বেগমের জিম্মায় জামিনে মুক্তি পেয়েছে সে।
খালাস চেয়ে ঐশীর আপিল
Share!