Wednesday , 3 July 2024
সংবাদ শিরোনাম

‘সাকা-মুজাহিদের রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় শিগগিরই’

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের রিভিউ আবেদন খারিজের রায়ের কপি সংক্ষিপ্ত আকারে নয়, পূর্ণাঙ্গভাবে শিগগিরই প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন আপিল বিভাগ। বুধবার সকালে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে এ কথা জানান। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সকালে আপিল বিভাগের কাছে সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের রিভিউ খারিজের সংক্ষিপ্ত রায় দেয়ার আবেদন জানানো হয়। এ সময় আদালত বলেন,তাদের রিভিউ আবেদন খারিজের রায়ের কপি সংক্ষিপ্ত আকারে নয়, পূর্ণাঙ্গভাবে শিগগিরই দেয়া হবে।এর আগে বুধবার সকাল ৯টার দিকে সাকা চৌধুরীর রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শুরু করেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ। বেলা ১১টার মধ্যে এই আবেদনের শুনানি গ্রহণ শেষ করেন আপিল বিভাগ। বেলা সাড়ে ১১টায় রায় ঘোষণার জন্য ধার্য করা হয়। ৩০ মিনিটের বিরতি থেকে ফিরে বেলা ১১টা ৩৩ মিনিটে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ আবেদনই খারিজ করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। এর আগে একই বেঞ্চ ১৭ নভেম্বর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি গ্রহণ করেন। শুনানি গ্রহণ শেষে বুধবার রায় দেয়ার দিন ধার্য করেন। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হচ্ছেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।সাকা চৌধুরীর রিভিউ খারিজের বিষয়ে খন্দকার মাহবুব সাংবাদিকদের বলেন, তাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার ডিগ্রির সার্টিফিকেট আদালতে উপস্থাপন করেছি। এ ব্যাপারে মাহবুবে আলম বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া যে ডুপ্লিকেট সার্টিফিকেট আদালতে দাখিল করেছেন সেটা ২০১২ সালে ইস্যু করা। আদালত তা গ্রহণযোগ্য মনে করেননি।মুজাহিদের রায় পুনর্বিবেচনার ব্যাপারে খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘আদালতে আমরা বলেছি, চার্জ-৬-এ যে দণ্ডটা দেয়া হয়েছে, সেটা ‘নট ইন অ্যাকোর্ডেন্স উইথ ল’। এখানে যে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে এই ধারায় তার সাজা হতে পারে না। বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে এর আগে ৪২টি মামলা হয়েছে, সেখানে মুজাহিদের নাম ছিল না। আলবদরের কোনো তালিকায় তার নাম পাওয়া যায়নি বলে তদন্ত কর্মকর্তাও বলেছিলেন।মুজাহিদের রায়ের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করছি এজন্য যে, তাকে শাস্তি দেয়া হল বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায়। ১৯৭১ সালের ১৩-১৪-১৫ ডিসেম্বর যত সংখ্যক বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছে সেটা পৃথিবীর আর কোথাও করা হয়নি। এই বিচার যদি আমরা না পেতাম তাহলে অতৃপ্তি থেকে যেত। এ রায় আমাদের শক্তি, সান্ত্বনা।’পাঁচ মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি : যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত পাঁচটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হল। এর আগে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন যা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কার্যকর হয়। দলটির অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয় গত এপ্রিলে। এছাড়া জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দিলেও আপিল বিভাগ তার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেন। এই রায়ের কপি আজও প্রকাশিত হয়নি। রায় প্রকাশিত হলে সরকার রিভিউ আবেদন দায়ের করবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল।মুজাহিদের বিচার : ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার হন ৬৭ বছর বয়সী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। এরপর একই বছরের ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয় জামায়াতে ইসলামীর এই সেক্রেটারি জেনারেলকে। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাতটি অভিযোগ আনা হয়। ২০১২ সালের ২১ জুন ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণের পর হত্যা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ওই দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেয়া হয়েছিল। একই রায় এসেছিল সপ্তম অভিযোগে, ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায়। চূড়ান্ত রায়ে চলতি বছরের ১৬ জুন আপিল বিভাগ মুজাহিদের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে প্রথম অভিযোগে আসামিকে খালাস দেয়া হয়। সপ্তম অভিযোগে তার সাজা কমিয়ে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত।সাকা চৌধুরীর বিচার : ২০১০ সালের ২৬ জুন হরতালের আগের রাতে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় গাড়ি ভাংচুর ও গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের ভোরে গ্রেফতার করা হয় তাকে। ১৯ ডিসেম্বর একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় সাকা চৌধুরীকে। পরে ৩০ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো সাকা চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২৩টি অভিযোগ আনে। এর মধ্যে ১৭টি অভিযোগের সপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর বিচার শেষে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল-১ তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। রায়ে প্রসিকিউশনের আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। এর মধ্যে চার অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচ অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়।এ বছর ২৯ জুলাই সর্বোচ্চ আদালত তার আপিল আংশিক মঞ্জুর করে আটটিতে দণ্ডাদেশ বহাল রাখে, একটিতে সাকা চৌধুরীকে খালাস দেয়া হয়। ৩, ৫, ৬ ও ৮ নম্বর অভিযোগে চট্টগ্রামের রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের ঘটনায় তার সর্বোচ্চ সাজা বহাল রাখা হয়। ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ২০ বছরের কারাদণ্ড বহাল থাকলেও ৭ নম্বর অভিযোগে ২০ বছরের সাজার ক্ষেত্রে আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দেয় আপিল বিভাগ। ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া পাঁচ বছর কারাদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয় চূড়ান্ত রায়ে।রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ ও রিভিউ আবেদন দায়ের : গত ৩০ সেপ্টেম্বর এই দুই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড বহাল সংক্রান্ত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়। ওই দিনই রায়ের কপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেয় সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল তাদের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে কারাগারে পাঠায়। মৃত্যু পরোয়ানা হাতে পেয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক মুজাহিদ এবং কাশিমপুর কারাগারে আটক সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে তা পড়ে শোনায় কারা কর্তৃপক্ষ। আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী আসামিপক্ষ রায়ের কপি হাতে পাওয়ার অথবা আসামিকে মৃত্যু পরোয়ানা জারির বিষয়টি পড়ে শোনানো যেটি আগে হয়, সেই হিসাব ধরে তারা রিভিউ আবেদন করার জন্য ১৫ দিন সময় পান। সেই হিসাবে নির্ধারিত সময়ের ১ দিন আগেই (১৪ অক্টোবর) আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রিভিউ আবেদন দায়ের করেন।নিরাপত্তা বলয় : এদিকে রিভিউ আবেদনের ওপর আপিল বিভাগের আদেশ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার থেকে সুপ্রিমকোর্ট এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সমন্বয়ে এ বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। বুধবারও একই অবস্থা ছিল আদালত চত্বরে। তিন স্তরের নিরাপত্তাবলয় ভেদ করে আদালতের ভেতর প্রবেশ করতে দেয়া হয় সংবাদকর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top